তৈরি পোশাকশিল্পের আলো আঁধার
তৈরি পোশাকশিল্প দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে এ খাতের অবদান অনন্য; প্রায় ৮৫ শতাংশ। এই সেক্টরে প্রায় চল্লিশ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ নারী; আগে এখানে এদের হার ছিল ৮০ শতাংশ। সেটা কিছুটা কমে এখন ৫৪ শতাংশ নারী কর্মী এই সেক্টরে অবদান রেখে চলেছে। যে কোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। এই সেক্টরের প্রসার দেশের সামাজিক অচলায়তনকে ভেঙে লৈঙ্গিক সমতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিশেষ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে চলেছে।
দেশে এ শিল্পের ভৌতিক ও কাঠামোগত উন্নতি চোখে পড়ার মতো। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর প্রধানত ক্রেতাদের চাপে এই উন্নতির শুরু। ক্রেতাদের চাপ ছিল স্বাস্থ্যকর পরিবেশসম্মত টেকসই সবুজ কারখানা ছাড়া অন্য কোনো শিল্পে উৎপাদিত পণ্য তারা আর ক্রয় করবেন না। সরকার ও শিল্পপতিরা এই চাহিদা পূরণে দ্রুত সাড়া দেয়; গড়ে তোলে একের পর এক টেকসই সবুজ কারখানা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (USGBC) ৯টি শর্তের আওতার ১১০ নম্বরের ভিত্তিতে কোনো কারখানাকে সবুজ হিসেবে চারটি ক্যাটাগরিতে লিড প্রশংসাপত্র (LEED, Leadership in Energy & Environmental Design) দিয়ে থাকে। কোনো কারখানা ৮০ বা তদূর্ধ্ব নম্বর পেলে দেওয়া হয় লিড প্লাটিনাম; এর নিচে ৪০ পর্যন্ত প্রাপ্ত কারখানাগুলোর জন্য রয়েছে লিড গোল্ড (৬০-৭৯), লিড সিলভার (৫০-৫৯) ও লিড সার্টিফিকেশন (৪০-৪৯)।
সবুজ কারখানা নির্মাণে দেশের সাফল্য অসাধারণ; দেশে এখন সবুজ সনদপ্রাপ্ত কারখানার সংখ্যা ২০০ অতিক্রম করেছে। আরও ৫০০ কারখানা এই সনদপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা করছে। যে দুশ কারখানা সনদ পেয়েছে, তার মধ্যে ৭৩টি লিড প্লাটিনাম, ১১৩টি লিড গোল্ড, ১০টি লিড সিলভার ও ৪টি লিড সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত। মজার বিষয় হলো, বিশ্বে সবচেয়ে বড় ১৫টি সবুজ সনদপ্রাপ্ত কারখানার মধ্যে ১৩টির অবস্থান বাংলাদেশে। ২০২২-২৩ সালে গার্মেন্টস খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৬.৯৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৭২ বিলিয়ন ডলার; এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে ৬০ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্যমন্ত্রীর আশা, ২০৩০ সালে এ খাত থেকে সম্ভাব্য আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হবে ১০০ বিলিয়ন ডলার।
ভৌতিক উন্নতির এই প্রজ্বলিত আলোর নিচে লুকিয়ে আছে অন্ধকার। পোশাকশিল্পে যারা কাজ করেন, তাদের মধ্যে শ্রমিকদের, অর্থাৎ অধিকাংশ শ্রমজীবীর বেতন-ভাতা মানসম্পন্ন জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত নয়, এটা বড়জোর দারিদ্র্যসীমা সমতুল্য। অনেক দেনদরবারের পর ২০১৮ সালে প্রবেশ পর্যায়ে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা হয় ৮,০০০ টাকা। এর মধ্যে পাঁচ বছর গত হয়েছে, বাজারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে, মূল্যস্তরের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি সূচিত হয়েছে, তাতে শ্রমিকদের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়েছে। এএফডব্লিউএ (A hungry man is an angry man )-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ২০২১ সালে একজন গার্মেন্টস শ্রমিক যে বেতনভাতা প্রাপ্ত হয়েছে, তা দিয়ে পরিবারের সদস্যরা প্রতিদিন গড়পড়তা ১৯৫০ কিলোক্যালরির খাদ্য গ্রহণ করতে পেরেছে।