খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে আমাদের সাফল্য কতটুকু?
আজ ভাদ্র মাসের ৩০ তারিখ। একদিন পরই আশ্বিন মাস। ভরা শরৎকাল। বনে কাশফুল ফুটবে। কৃষকরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টির জলে বন্যার উপক্রম হচ্ছে। কোথাও কোথাও কৃষকরা আউশ ধান তুলছেন। ধানের বাজার মোটামুটি। সঙ্গে সঙ্গে চলছে আমন ধানের চারা রোপণ। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আমন লাগানোর ধুম। কৃষি শ্রমিকের অভাব হচ্ছে। একদিকে আউশ তোলা, অন্যদিকে আমনের চারা রোপণ। স্বভাবিকভাবেই কৃষি শ্রমিকের দরকার বেশি। আরো বেশি কারণ এখনই পাট তোলার সময়। জাগ থেকে পাট তুলে পাটের আঁশ ছাড়াতে হবে পাটখড়ি থেকে। পাট শুকাতে হবে। বৃষ্টি হলেই সমস্যা। পাট শুকানোর সমস্যা, আউশ ধান শুকানোর সমস্যা। আউশ তোলা, আমনের চারা রোপণ, পাট জাগ থেকে তুলে সোনালি আঁশ আহরণ ইত্যাদির ছবি প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের সুখ-দুঃখের কথাও বর্ণিত হচ্ছে। প্রাক-ফসল ও ফসলোত্তর কালের সমস্যা সবই প্রতিবেদকরা তুলে ধরছেন। এটা আমাদের প্রিয় গ্রামবাংলার চিরায়ত দৃশ্য। অবশ্য এসব এখন বড় বড় খবর নয়। বড় বড় খবর হচ্ছে—জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মাথাপিছু আয়, বিনিয়োগ, মেগা প্রকল্প, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি। আর আন্তর্জাতিকভাবে বড় খবর হচ্ছে জি২০-এর খবর, যা অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভারতের নয়াদিল্লিতে। বিশ্বের তাবৎ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধানরা সেখানে এখন।
এটা গ্লোবাল সাউথের একটা কর্মকাণ্ড। এখানে যেসব দেশ অংশগ্রহণ করছে তাদের সম্মিলিত জিডিপি বিশ্বের মোট জিডিপির ৮০ শতাংশ। এত বড় একটা সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ মর্যাদায় তার অংশগ্রহণ। খুব কম দেশই এ সম্মান পেয়েছে। বড় বড় ঘটনা ঘটেছে সেখানে। সিদ্ধান্ত হয়েছে ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে যাবে রেললাইন। বিশাল ঘটনা। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সমান্তরাল উদ্যোগ। এসবের সাক্ষী হয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরেছেন। ফিরেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁকে অভ্যর্থনা-স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশে। এটা আরেক বিশাল খবর আমাদের জন্য। আমরা এক উচ্চতা থেকে আরেক উচ্চতায় উন্নীত হচ্ছি। বলাই বাহুল্য, এতসব বড় ঘটনার মধ্যে কি ছোট ছোট সুখ-দুঃখের খবর কেউ শুনতে চায়? অথচ দেশে ছোট ছোট দুঃখ আছে, যা লাখ লাখ মানুষকে উৎপীড়িত করে, ভোগায়। ছোট ছোট দুঃখের মধ্যে আমি মূল্যস্ফীতির বিষয়টিতে টেনে আনছি না। কারণ এটা বড়, খুবই বড় ইস্যু। কিন্তু বড় ইস্যু হিসেবে দেখা হচ্ছে না এমন বিষয় দেশে প্রচুর। মিডিয়ায় এসব খবর তুলনামূলকভাবে কম। যেমন কাঁচা পাটের বাজারের খবর। আগেই বলেছি, এখন কৃষকরা ঘরে নতুন পাট/সোনালি আঁশ তুলছেন।
একসময় ‘সোনালি আঁশ’ ছিল ম্যাট্রিক, এসএসসি পরীক্ষায় রচনার বিষয়বস্তু। আমরা এ রচনা মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়েছি। সেই দিন আর নেই। কাঁচা পাট আগের মতোই যে আঁধারে ছিল সেই আঁধারেই আছে। কুড়িগ্রামের একটি খবরে (১০.০৯.২০২৩) দেখলাম, সেখানে কৃষকরা এবার কাঁচা পাটের ভালো ফলন পেয়েছেন। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এবার পাটের মণপ্রতি দাম কম। এখন সেখানকার বাজারে কাঁচা পাট বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা মণ। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচই মেটে না। দেখা যাচ্ছে, আজ থেকে ৫০-৬০-৭০ বছর আগে যে অবস্থা ছিল, আজও তা-ই। পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-৭১) দেখতাম, গ্রামের বাজারে কৃষকরা কাঁচা পাট মাথায় নিয়ে মহাজনের ঘরে ঘরে ঘুরছেন। পাট বিক্রি হচ্ছে না। পাটের ক্রেতা নেই। কৃষকরা রাগে-দুঃখে, ক্ষোভে বাজারেই পাট ফেলে বাড়ি ফিরছেন খালি হাতে, কেরোসিনের খালি বোতল হাতে। বাজারের পণ্য তার হাতে নেই। আজও একই অবস্থা খবরে দেখা যাচ্ছে। এক মণ পাটের দাম ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। অথচ একটি ইলিশের দামও ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। ছোট হলে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা। তার অর্থ, এক মণ পাটের টাকায় একটা ইলিশ। পাঁচজনের সংসারে এই ইলিশ এক বেলার খাবার। তাও সন্তানদের আবদার রাখার মতো অবস্থা নয়। শুধু ইলিশের কথা বলি কেন, যেকোনো ধরনের মাছের দামই এখন আকাশচুম্বী। কই, শিং, মাগুরের কেজি কত?
- ট্যাগ:
- মতামত
- খাদ্য নিরাপত্তা
- কৃষি উৎপাদন