মৃত্যুর শীতল বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ে
মহাবিস্ফোরণে মহাবিশ্বের মহাকাশের সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেলে ঘন ঘোর অন্ধকার নামে। এ সৃষ্টিকাল নয় যে আলোর কণা থেকে অগ্নিময় মহাসূর্যের জন্ম হবে। অন্ধকারের কাল। সেই নিকষ অন্ধকার আসমানের অদৃশ্য সিঁড়িতে পা ফেলে ইবলিশ নেমে আসে দুনিয়ার মাটিতে। মানুষ ছিল নিদ্রাকাতর। মহাঘুম তাদের নিস্তব্ধতার দুনিয়ার কবর গুহায় লুকিয়ে রাখে। জেগে থাকলেই ওরা কেউ না কেউ দেখতে পেত একটি অতিকায় কালো মূর্তির অদৃশ্য মাথায় আগুনের ফুলকির মতো দুটো চোখের মণি জ্বালিয়ে কে যেন আকাশ পথে দুনিয়ায় নেমে এসেছে। কখনো? সময় কালের সীমানা কী? এ প্রশ্নে ছত্রখান হয়ে জাগ্রতরা অনুমান করতে পারত মাসটির নাম আগস্ট। খোদার সৃষ্টি এই দুনিয়ার একমাত্র মহাদুর্যোগের মাস। ইবলিশ কর্তৃক মানবের জবরদখলের পাপ-পঙ্কিল মাস। খোদার অভিশপ্ত মাস।
মানুষ কখন ঘন নিদ্রার মাদকতার ভেতর আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তাদের স্থূল দেহ ইথারতরঙ্গ কিংবা ইথালিক দেহ ধারণ করে তখনই চেতনার জগৎ ছেড়ে যায়। ঠিক তখনই ৩২ নম্বর বাড়িটি থেকে প্রথমে গর্জন শেষে আর্তনাদের শব্দতরঙ্গ আছড়ে পড়ে সামনের সাপের মতো আঁকাবাঁকা লেকের কালো পানিতে। নক্ষত্রশূন্য অন্ধকার রাতের নিকষ অন্ধকারে ডুবে থাকা লেকের পানিতে তখন তরঙ্গের পর তরঙ্গ আলেয়ার সৃষ্টি করে। সেই আলেয়ার আগুনে জ্বলে জ্বলে সব পানি পরিণত হয় লাল রক্তে। চলমান সাপের মতো আগুনজ্বলা রক্তস্রোত আঁকাবাঁকা লেকের ভেতর ঘূর্ণি স্রোত হয়ে বয়ে যায়।
তখন ওই দূরে অন্ধকারের বিতান ছিঁড়ে ছিঁড়ে আচমকা শোনা যায় নবজাতকের কান্না। কোন শিশু জন্ম নিল এই কিয়ামতের রাতে? তারপর হাসি। হাসির বজ্রশব্দ মাটি আর আসমানকে চাঁদোয়ার মতো ঢেকে দেয়। হাসির মেঘ গর্জনের সঙ্গে মিশে আছে যে নবজাতকের কান্না, তার কোনো রূপ নেই। এ যেন নিরাকার মানব শিশুর বাতাসের মতো অদৃশ্য কান্না। অলীক শব্দতরঙ্গ।
তখনো কেউ জেগে ওঠেনি। ঘুমের আচ্ছন্নতায় সাপের ছোবলে আর্তনাদশূন্য মানুষ যেমন মরণের নদী পেরিয়ে যায় নীরবে, মানুষগুলোর ঘুম ভাঙলেই ওরা দেখতে পেত এমন একজনকে যিনি অর্ধশতাব্দী নির্ঘুম কাটিয়েছেন। আজীবন নির্ঘুম বিনিদ্র মানুষটির ওই যে তার মায়ের গর্ভ ছেড়ে মাতৃভূমির মাটিতে নেমেই প্রথম কান্নার ভেতর ঘুম ভাঙল, গর্ভঘুম, তারপর জেগে থেকেই কেটে গেল ৫৫টি বছর। ১৯২০ থেকে ১৯৭৫। আগস্ট মাস। স্বর্গ থেকে শয়তানের মর্তে বিতাড়নের মাস। এ মাসেই তিনি মহাঘুমে পড়লেন।