বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতার কড়চা
ছোটবেলায় ঈশপের সারস-শিয়ালের বন্ধুত্বের গল্পটি পড়েছিলাম। পশু ও পাখির ভেতর বন্ধুত্ব হয়েছিল বটে তবে একে অপরের গৃহে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে তারা চরম বিড়ম্বনার মুখে পড়ে। খাবার খেতে পর্যন্ত পারেনি। পশু ও পাখির এই অসম বন্ধুত্বের সারবস্তু তখন ঠিক বুঝিনি। মানুষে মানুষে শ্রেণি পার্থক্যের উপমা হিসেবে গল্পটি খাপ খায়। শ্রেণি বিভাজন অতিক্রম করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্প্রীতি, হৃদ্যতা, অনাবিল আন্তরিকতার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়।
সমাজে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিস্তার ঘটেছে বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতার। একান্নবর্তী পরিবারে ভাইবোনরা পরস্পর যেভাবে আন্তরিকতায় বেড়ে ওঠে, পরবর্তী জীবনে সেই ভালোবাসায় ভাটির টান পড়ে পরিবারের সদস্যদের ভেতর অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে। একই মা-বাবার সন্তানদের মধ্যে কেউ যদি অন্যদের তুলনায় বিত্তশালী হয়ে ওঠে, তা হলে অন্য ভাইবোনদের থেকে তার বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে যায়। বদলে যায় দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মীয়তার জগৎ। অনাত্মীয় হয়ে পড়ে আত্মীয় আর নিকট আত্মীয় হয়ে যায় অনাত্মীয়।
সমাজে আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে আমরা বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের পরিচয় দিতে পছন্দ করি নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির তাগিদে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- যার পরিচয় দেওয়া হয়, তিনি তুলনায় নিম্ন অবস্থানের আত্মীয়ের পরিচয় দেওয়া পরের কথা; তাদের স্মরণেও রাখতে চান না। একটি ঘটনার কথা শুনেছিলাম। বিত্তবান ভাইয়ের বাড়ির মূল ফটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিম্নবিত্ত এক ভাই। পথচারী একজন বিশাল ওই বাড়িটির মালিক কে জানতে চাইলে ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইটি সগর্বে বলে ওঠেন- ‘কেন, আমাদের বাড়ি।’ পথচারী বলেন- ‘ভাই, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, এক গ্লাস পানি খাওয়াবেন?’ ভীষণ বিপদ-সংকোচে পড়ে যান নিম্নবিত্ত ভাইটি। অগত্যা সত্য কথাটি বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে- ‘ভাই, দুঃখিত; অনুমতি ছাড়া বাড়ির ভেতরে যাওয়ার আমার অনুমতি নেই। আমি অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।’ জানি না এটি সত্য ঘটনা, নাকি গল্প। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় অসত্য বলার উপায় নেই।
নিকট আত্মীয়ের ঘন ঘন চাকরির দাবিতে বাধ্য হয়ে উচ্চমধ্যবিত্ত এক ব্যক্তি নিজেদের যৌথ মালিকানার অনেক প্রতিষ্ঠানের একটিতে হিসাবরক্ষকের চাকরি দেন। তবে ছেলেটির আত্মীয় পরিচয় গোপন রেখে অংশীদারদের কাছে পরিচয় দেন গ্রামের ছেলে বলে। ছেলেটি আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই পায়নি। মেসে থেকে চাকরি করছে। এমনকি সেই আত্মীয়ের বাড়িতে একদিনের জন্যও তার প্রবেশ ঘটেনি। এটিও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, বিচ্ছিন্নও নয়।