তিনিই আমাদের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পুঁজি
সবার প্রিয় নেতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। কেউ বলতেন ‘খোকা’, কেউ ডাকতেন ‘মুজিব ভাই’। কেউ বা বলতেন ‘লিডার’। সবশেষে প্রায় সবার কাছে হয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। এখনো এ নামেই তিনি স্বতোৎসারিত। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যখন বাংলাদেশ হাঁটছিল উলটো পথে, ইতিহাস থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করার ছলচাতুরী করা হচ্ছিল ব্যাপকভাবে, তখন কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসের তিনি শুধু নির্মাতা নন, তার প্রধান নায়কও। ... তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না।’ তার সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে। আজ তিনি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়জুড়ে অবস্থান করছেন। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘আমার দেখা নয়া চীন’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়লেই যে কেউ বুঝতে পারেন কীভাবে একটি জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় তিনি শত বছরের ঐতিহ্যের সম্মতিকে থিতু করেছেন বাংলাদেশ নামের এ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ডে। ধীরে ধীরে তিনি গড়ে তুলেছেন বাঙালির মানসপট। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে সেই মানসতটে। তার বজ্রকণ্ঠে অনুরণিত হয়েছে হাজার বছরের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর পুঞ্জীভূত অভিমান, আবেগ ও প্রতিবাদ। তাই এ কণ্ঠের অধিকারীর সঙ্গে যোগ রাখলেই পুরো সমাজ ও পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতির সঙ্গে যোগ রাখা হতো। অতীতের সব মহৎ অর্জন, বৃহৎ সাফল্য; ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, তিতুমীর, সুভাষ বোস, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ চন্দ্র বসু, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মতো সাহসী নেতৃত্বের নির্যাস তিনি ধারণ করেছিলেন নিজের মধ্যে। সেই সাহসী নেতৃত্বের গুণাবলি ছড়িয়ে দিয়েছেন পুরো সমাজের ভেতর। আশা করার, স্বপ্ন দেখার অধিকারের ক্ষেত্রকে তিনি বাঙালির মনে বিস্তৃত করেছেন নিরন্তর। তার সক্রিয় নেতৃত্বের বিস্তৃতি ছিল তাই সর্বব্যাপী। বরাবরই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত তথা সব সাধারণ মানুষের মনোযোগের একেবারে কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল জায়গায় ছিল বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়। শাসকশ্রেণি জনগণের ন্যায্য দাবি মানতে অস্বীকার করলে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। শেষ পর্যায়ে তিনি বেছে নিয়েছেন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পথ। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটকে পুরোপুরি ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তো ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলা ময়দানে এক জনসভায় বলতে পেরেছিলেন, ‘ভাষা-আন্দোলন শুধু ভাষার দাবিতে ছিল না, সেটা ছিল আমাদের জীবন-মরণের লড়াই। আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই। আমরা খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, আশ্রয় চাই, নাগরিক অধিকার চাই।’