দেশভাগ না অর্জন
প্রথম দেখা বরিশালের কথা কখনো ভুলব না। ঢাউস স্টিমারের কেবিনে সারেংদের হাতে রাতের খাবার, ভাত আর মুরগির ঝোলের অপূর্ব স্বাদ এখনো যেন মুখে লেগে রয়েছে। স্টিমার বলছি বটে, আসলে তো টাইটানিক জাহাজের মতো বিশাল, বিপুল এক জলযান। ঢাকা সদরঘাটে গেলেই সারেং, খালাসি, কুলিদের চিৎকারে পুরো তল্লাট জমজমাট। দূরদূরান্তের যাত্রীদের বাক্স প্যাটরা নিয়ে ছোটাছুটি দেখতে বেশ লাগে। কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফরিদপুর কত কত জায়গায় লোকে চলেছে। আমি তো চলেছি বরিশাল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ডেকে দাঁড়িয়ে আনমনে দূরের শহরের আলো দেখতে দেখতে কখন যে স্টিমার চলতে শুরু করেছে, টের পাইনি।
আমাকে একটু-আধটুও যারা জানেন, তারা সবাই জেনে গেছেন বাংলাদেশের ওপর যেকোনো কারণেই হোক আমার বেশ টান আছে। আসলে একটা দেশ সংগ্রাম, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছে, এটা ভাবলেই রোমাঞ্চিত হই। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তা নিঃসন্দেহে গত শতাব্দীর এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঢাকার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি যেন ১৯৭১-এর পঁচিশে মার্চে চলে যাই। ওই তো সামনেই আসাদ গেট। ’৭১-এর আগে ’৬৯-এর আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনের প্রথম শহীদ আসাদুজ্জামানের কথা কজন মনে রেখেছেন জানি না, কিন্তু এই গেট তার স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখেছে।
তবে ঢাকা মানেই তো আর বাংলাদেশ নয়। আসল দেশকে চিনতে হলে আপনাকে জেলায়, মফস্বলে, গ্রামে ঘুরতে হবে। ঘুরতে ঘুরতে আপনি বুঝতে পারবেন বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথম দেখা বরিশাল ছিল এক রোমান্টিক আখ্যান। ভোর ভোর কীর্তনখোলা নদী তীরে যে শহরকে দেখেছিলাম, তা প্রথম প্রেমের মতো মুগ্ধ করেছিল। সেই দেখায় মুগ্ধতা ছিল, রোমান্টিকতা ছিল। কিন্তু বাস্তবের সত্য মিথ্যা ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত। এখন যেতে যেতে অনেক কিছু চোখে পড়ে। যাতে বুঝতে পারি শুধু বরিশাল নয়, গোটা বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে বদলে যাচ্ছে। ব্রিটিশ আমলেও বরিশালে রেলপথ হওয়ার কথা ছিল নিছক কল্পনা। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেও বরিশালে যাওয়া মানেই স্রেফ জলপথ। এখন শোনা যাচ্ছে আর কিছুদিনের মধ্যেই বরিশাল, ভোলা হয়ে পটুয়াখালী অবধি পৌঁছতে পারবেন ট্রেনে।
কয়েক বছরের মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উপরিকাঠামো নির্মাণ চমকে দেওয়ার মতো। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের কাছে উন্নয়নের মডেল হিসেবে বাংলাদেশ রোল মডেল। কলকাতা থেকে আগে বাসে যেতে হলে পদ্মা পার হয়ে যে সময় লাগত, এখন পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ায় ঢাকা অনেক কাছে চলে এসেছে। গোয়ালন্দ বা রাজবাড়ী ঘাটের জ্যাম এখন অতীত। কাগজে কলমে জিডিপি বেড়েছে। প্রত্যন্ত এলাকায় মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। গ্রামের রাস্তা পুরনো দিনের চেয়ে অনেক ঝা চকচকে। শহরে শপিংমল, আধুনিক গাড়ির শোরুম, ফুড কোর্ট, রেস্তোরাঁ সব নাগালের মধ্যে। ঢাকা তো যেকোনো দেশের রাজধানীর মতোই বিশ্বায়ন পরবর্তী আধুনিক শহর। গগনচুম্বী বহুতল, অত্যাধুনিক শপিংমল, নতুন গাড়ির মডেল ইত্যাদি। এক ঢাকার মধ্যে আছে অনেক ঢাকা। বহু তলের পাশাপাশি আছে ধাঙ্গর বস্তি। শপিংমলের কাছেই এতিমখানা। আর আছে রঙবেরঙের হাজার হাজার রিকশা। লোকাল বাস, সিএনজি সবসময় ছুটছে। এবার তো ঢাকায় মেট্রোরেল দেখতে পেলাম। শহরটি একটু যেন পরিচ্ছন্ন হয়েছে। বিখ্যাত জ্যাম অবশ্য বদলায়নি। এপারে আমরা যে সবসময় হিন্দু নির্যাতনের কথা শুনি, বাস্তবে ছবিটা তেমন নয়। কোথাও কোনো সমস্যা নেই বলছি না। তবে এখানে যেমন হৈচৈ করে নন ইস্যুকে রাজনৈতিক ইস্যু করে তোলা হয়, তেমন পরিস্থিতি এখনো বাংলাদেশে হয়নি। কয়েক বছরের মধ্যে মসজিদের সংখ্যা বেড়েছে। তেমনি নতুন মন্দির নির্মাণ হচ্ছে এটাও সত্যি। বোরকা, হিজাব বেড়েছে এটা নিয়ে সংশয় নেই। তবে তা শুধু মৌলবাদী কারণে তা মোটেও ঠিক না। এর পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক অজস্র কারণ আছে।