মানব কেন দানব?

সমকাল সম্পাদকীয় প্রকাশিত: ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০২:০০

গত রবিবার ঢাকা শিশু হাসপাতালে মামুন নামে জনৈক তরুণকে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে যেইভাবে অন্তত ১০ জনে মিলাইয়া পিটাইয়া হত্যা করিয়াছে, তাহা আমাদিগকে নূতন করিয়া পুরাতন প্রশ্নটির সম্মুখে দাঁড় করাইয়া দিয়াছে– সমাজে বর্বরতার বাড়বাড়ন্ত কেন? তুচ্ছ অপরাধের ‘বিচার’ স্বহস্তে তুলিয়া লইতে গিয়া এইরূপ বৃহত্তর অপরাধ সংঘটনের সংখ্যা ও মাত্রা যে ক্রমেই বাড়িয়া চলিয়াছে, প্রায় নিয়মিত বিরতিতে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনেই উহা স্পষ্ট। যেমন চলতি বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসের চতুর্থ সপ্তাহেও চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জনৈক ইছাহাককে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ বেদম প্রহারে হত্যা করা হইয়াছে।


বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যাইতেছে ২০১১ সাল হইতে গত বৎসর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৯৫৪ জন এই প্রকার গণপিটুনির শিকার হইয়া প্রাণ হারাইয়াছেন। ইহার বাহিরে আরও অঘটন যে রহিয়াছে, উহা বুঝিবার জন্য বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই।


স্মরণ করা যাইতে পারে, তুচ্ছ চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে এইরূপ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সমাজে ও সংবাদমাধ্যমে নিকট অতীতে প্রথম আলোড়ন তুলিয়াছিল ২০১৫ সালের জুলাই মাসে সিলেটের খণ্ডকালীন সবজি বিক্রেতা শিশু শেখ সামিউল আলম রাজনকে দিয়া। তাহাকে কয়েকজন মিলিয়া প্রকাশ্য পিটাইয়া হত্যাই কেবল করেনি, ভিডিওচিত্র ধারণ করিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল। একইভাবে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে চুরির অপবাদে জনৈক কিশোর সাগর মিয়াকে পিটাইয়া হত্যা করা হইয়াছিল। খুঁটিতে বাঁধা ওই কিশোরের দেহ প্রহারের প্রাবল্যে নেতাইয়া পড়িবার চিত্র তখন পাষণ্ড হৃদয়কেও অনিবার্যভাবেই বেদনাহত করিতে পারিত। কিন্তু ‘ভাইরাল’ হইয়া পড়া ভিডিওচিত্রে আমরা গভীর উদ্বেগ ও বেদনার সহিত দেখিয়াছিলাম– চারিপার্শ্বের উৎসুক জনতা কেবল কৌতুকই করিতেছে, কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও ঐ কিশোরকে বাঁচাইতে কেহ আগাইয়া আসিতেছে না। তুচ্ছ ঘটনায় আরও যেই সকল কিশোর বা তরুণ কিংবা পরিণত বয়স্ক ব্যক্তির এই প্রকারে প্রাণসংহার হইয়াছে, তাহাদের সকলের ক্ষেত্রে ভিডিওচিত্র পাওয়া না গেলেও অনুমান করা অমূলক হইবে না যে, সেইখানেও প্রহারকারী কিংবা উৎসুক জনতার হৃদয় গলেনি। ইহা কিরূপ নৃশংসতা সমাজকে গ্রাস করিয়া ফেলিতেছে?


আমরা রাজধানীর বাড্ডায় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেনুকে পিটাইয়া হত্যা করিবার দৃশ্যই বা কীভাবে ভুলিতে পারি? ঐ সময় দেশজুড়ে গুজব ছড়াইয়া পড়িয়াছিল যে, তৎকালে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু প্রকল্পে শিশু বিসর্জন দিতে হইবে। তাহার জের ধরিয়া মানসিকভাবে কিঞ্চিৎ অস্থিতিশীল ও বাকশ্লথ রেনুকে নিশানা করে উপস্থিত কতিপয় ‘অভিভাবক’। সন্তানকে স্কুলে ভর্তির খোঁজ লইতে গিয়া পরিস্থিতি বুঝিয়া উঠিবার পূর্বেই শত শত ‘মানুষ’ তাঁহার ওপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া প্রাণ সংহার করিয়াছিল। ঢাকা শিশু হাসপাতালে মামুনের সহিতও প্রায় একই ঘটনা ঘটিয়াছে। বারংবার প্রাণভিক্ষা চাহিয়াও তাহার রেহাই মেলে নাই।


আমরা জানি না, মুমূর্ষু ঐ সকল ব্যক্তির শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে কতটা দীর্ঘশ্বাস মিশিয়া থাকে! সড়ক দুর্ঘটনায় যখন কেহ প্রাণ হারান, তখন আমরা ক্ষুব্ধ হই, হতাশ হই, নিয়ম প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেই; কিন্তু এই সকল ক্ষেত্রে কী বলা যায়! রেনু কিংবা মামুনের সন্তান কিংবা স্বজনের চক্ষুর প্রতি দৃষ্টিপাতের সক্ষমতা কি এই ‘হত্যাকারী’ সমাজের রহিয়াছে?


আমরা জানিয়াছি, মামুন হত্যার ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা হইয়াছে। তিনজনকে গ্রেপ্তারও করিয়াছে পুলিশ। কিন্তু গণপিটুনির অধিকাংশ ঘটনায় আসামি গ্রেপ্তার হয় না, নিহতের পরিবার বিচারও পায় না। সংবাদমাধ্যমে কিছুদিন তরঙ্গ তুলিয়াই উহার পরিসমাপ্তি ঘটে।  গ্রেপ্তার  হয় না। বিচার পায় না নিহতের পরিবার। স্বীকার করিতে হইবে– সমাজে হত্যা ও নৃশংসতা অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা; কিন্তু কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকা তাঁহার গানে বলিয়াছিলেন– দানব কদাচ মানব হইয়া উঠিলে আমরা লজ্জা পাইব কি-না। মানবিকতার উৎকর্ষসাধন দূরে থাকুক; স্বাভাবিক বিবেচনাবোধও হারাইয়া ফেলিয়া মানুষ কেন নিষ্কম্প হস্তে হত্যায় মাতিতেছে– সমাজবিজ্ঞানীদের ভাবিতে হইবে বৈকি। একই সঙ্গে মনে রাখিতে হইবে– গণপিটুনির ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি যত দ্রুত কার্যকর সম্ভব হইবে, সমাজে এই প্রকার অপরাধের পুনরাবৃত্তি ততই কঠিন হইবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও