বিচ্ছিন্ন শুধু নয় বিশিষ্টও বটে

www.ajkerpatrika.com সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশিত: ২৯ মার্চ ২০২৩, ২০:০৭

দেশের বুদ্ধিজীবীরা যে পরিমাণে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে যুক্ত করতে পেরেছেন, সেই পরিমাণেই তাঁরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তুলতে। কিন্তু বলাই বাহুল্য, বুদ্ধিজীবী সমাজের সব মানুষ সব সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকেননি। তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন নিজেদের স্বার্থকে জনসাধারণের স্বার্থ থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে দেখে। এটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে। বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন এ দেশের উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি চিরদিনই আত্মস্বার্থ সচেতন। তরুণ বয়সে আত্মত্যাগের সাহস থাকে, পরিণত বয়সে আসে বিষয়বুদ্ধি। তাই পরিণত বয়সের বুদ্ধিজীবীরা স্বভাবতই সজাগ ছিলেন, ছিলেন আত্মসচেতন।


এর আরও একটা কারণ ছিল। উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভিত্তি ছিল অর্বাচীন ও দুর্বল। তাই এই শ্রেণির লোকদের পক্ষে কোনো ঝুঁকি নেওয়া কঠিন ছিল। পার্টিশনের আগে মুসলমান মধ্যবিত্তরা দেখেছিল অবিভক্ত বাংলার তুলনায় অধিকতর পুরোনো ও প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে তাদের নিজস্ব শ্রেণিগত বিকাশের সুযোগ খুব সংকীর্ণ। আশা ছিল পাকিস্তানে সেই বিকাশ অনেক সহজ ও দ্রুত হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মধ্যবিত্তদের মধ্যে তাই একটা ব্যস্ততা দেখা গিয়েছিল নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার। বুদ্ধিজীবীরাও ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সুবিধা যতটা আশা করা গিয়েছিল, ততটা পাওয়া যায়নি। সুযোগ অবাধ হয়নি, কিছুটা দ্রুত হয়েছিল যদিও। হিন্দুরা চলে যাওয়ায় চাকরি খালি হয়েছিল, সেগুলো পাওয়া গেল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। হিন্দু মধ্যবিত্তের জায়গায় নতুন প্রতিযোগী এসে জুটেছে, পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত, যারা আগে থেকেই অনেকটা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য তো বটেই, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের প্রধান যে অবলম্বন চাকরি, সেই চাকরির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে শক্তিশালী প্রতিযোগী হয়ে দেখা দিল তা নয়, চাকরির তারা মালিকও হয়ে রইল। ছোট-বড় সব রকমের চাকরির।


স্পষ্ট সত্য হয়ে দাঁড়াল এই, পশ্চিম পাকিস্তানিদের অসন্তুষ্ট করলে জীবিকা অর্জনের পথ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে, তুষ্ট করলে উন্নতি কিছু ঘটতে পারে। প্রধানত এই অর্থনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, সরে গিয়ে পাকিস্তানের গুণগানে ব্রতী হয়েছিল। এ কাজ করে তাঁদের লাভ হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে। তা ছাড়া, সামনে প্রত্যাশার একটা দিগন্তও দেখা যাচ্ছিল।


বুদ্ধিজীবীদের প্রলোভন দেখানোর কাজ পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই করেছে। উদ্দেশ্যটা সহজ। সরকার চেয়েছে জনসাধারণকে শোষণ করতে। বুদ্ধিজীবীরা যদি জনসাধারণের অংশ হয়ে যান, জনসাধারণের সঙ্গে থাকেন, তবে তাঁরা মানুষের চোখ খুলে দিতে পারেন। চোখ খুলে দিলে শোষণ করতে অসুবিধা। আর যদি বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে পাকিস্তানের মহিমা প্রচার করানো যায়, তাহলে শোষণ কাজটা আরও নির্বিঘ্নে হতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের জীবনে যেহেতু অভাব ছিল, সচ্ছলতা এবং লোভ ছিল স্বাচ্ছন্দ্যের, তাই অল্পতেই তাঁরা আকৃষ্ট হতেন। চাকরিতে উন্নতি, পুস্তকের জন্য পারিশ্রমিক, পরবর্তীকালে তমঘা ও পুরস্কার, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ—এসবের সাহায্যে জনসাধারণ থেকে বুদ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস সরকার করেছে, সক্ষমও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।


বুদ্ধিজীবী সমাজের, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবহারজীবী তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট যাঁরা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁদের প্রায় সবার জীবনেই সমৃদ্ধি এসেছে। তাই পাকিস্তানের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতাবোধ না থেকে পারেনি, তাঁদের জীবন ও সাধারণ মানুষের জীবন বিপরীত দিকে চলেছে, অনিবার্যভাবেই। তুলনায় যাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন কম, তাঁদের পক্ষেও সরকারি বক্তব্য সমর্থন না করে উপায় থাকেনি। এর কারণ, তাঁদের জীবনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবোধের অভাবটা ছিল আরও বেশি। তাঁরা ভয় পেয়েছেন যে সামান্য ধাক্কাতেই তাঁরা গড়িয়ে পড়বেন নিচের খাদে এবং ধাক্কার আশঙ্কা সব সময়ই ছিল। সরকার শুধু প্রলোভনই দেখায়নি, ভয়ও দেখিয়েছে এবং প্রলোভনের তুলনায় ভয় কিছু কম শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেনি। ভয়ের জন্য ভুলকে ভুল, অন্যায়কে অন্যায় বলে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মধ্যবিত্তের মনেও অর্থনৈতিক অসন্তোষ ছিল, কিন্তু সেই অসন্তোষ কিংবা তার চেয়েও বড় অসন্তোষ সাধারণ মানুষের অসন্তোষকে উন্মোচিত করার মতো পর্যাপ্ত সাহস বুদ্ধিজীবীদের অনেকের মধ্যেই দেখা যায়নি। ভয়টা কল্পিত ভয় ছিল না। বামপন্থী বলে পরিচিত যাঁরা, প্রয়োজনবোধে তাঁদের কারাগারে নিক্ষেপ করার ব্যাপারে সরকার দ্বিধা করেনি।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও