শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থার যেসব সংস্কার দরকার
রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে সহজে এর উন্নতি সাধন সম্ভব হবে না। অগ্রাধিকার ঠিক করে পর্যায়ক্রমে এগোতে হবে। প্রথম পর্যায়ের কাজের জন্য নিচের বিষয়গুলো কর্মসূচিভুক্ত করা যেতে পারে:
১. প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত রেখে এর মান উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাথমিক হচ্ছে পরবর্তী সব শিক্ষার ভিত্তি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। স্কুল থেকে প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনের সনদ দেওয়া হবে এবং এগুলোর প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকবে।
২. কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা-পদ্ধতি পরিবর্তন করে এমন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের মনে পাঠানুরাগ, অনুসন্ধিৎসা, জ্ঞানস্পৃহা, স্বাজাত্যবোধ, সামাজিক সম্প্রীতি, দেশপ্রেম, সুনাগরিকত্ববোধ ও উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা জাগাবে। পরীক্ষার জন্য মূলত বর্ণনামূলক উত্তরের পদ্ধতিকে নবায়িত ও বিকশিত করে কার্যকর করতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আনন্দের যোগ ঘটাতে হবে। বর্তমানে শিশু-কিশোরেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে শিক্ষার্থী হিসেবে, কিন্তু তার পরেই তারা বইয়ের বোঝা পিঠে নিয়ে পরীক্ষার্থী হয়ে যায়, শিক্ষার্থী আর থাকতে পারে না। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় শিক্ষা বোর্ডগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ইউনেসকো ও ইউনিসেফের অন্ধ-অনুসারীরা পরীক্ষা-পদ্ধতির অভিপ্রেত পরিবর্তন সাধনে বাধা দেবে।সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের অনুসারীরা দুর্বল জাতিগুলোর শিক্ষার উন্নতি চায় না, তারা কেবল ভালো সনদ দিয়ে পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সন্তুষ্ট রাখার ব্যবস্থা চায়। জ্ঞানেই শক্তি, জ্ঞানেই কল্যাণ—বৃহৎ শক্তিরা এটা বোঝে এবং জ্ঞানকে তারা কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।
৩. ইংলিশ ভার্সন বিলুপ্ত করতে হবে। যাঁরা সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে নাগরিক করার জন্য কিংবা বড় চাকরি পাওয়ার জন্য ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চান, তাঁদের জন্য ব্রিটিশ সরকার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল চালাচ্ছে। তা ছাড়া, আছে বিদেশি সরকার দ্বারা পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যমের আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেসবের পাশে ইংলিশ ভার্সনের দরকার নেই। ইংলিশ ভার্সনের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তার দ্বারা রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণের কোনো কল্যাণ হচ্ছে না।
বাংলাদেশে যাঁরা আজকাল কেবল বিশ্বমান অর্জনের কথা বলেন, তাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও জনজীবনের অবস্থার কথা একটুও ভাবেন না। যাঁরা দ্বৈত নাগরিক, যাঁদের স্ত্রী অথবা স্বামী অথবা সন্তান দ্বৈত নাগরিক কিংবা বিদেশি নাগরিক, তাঁরা যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপসচিব থেকে সচিব, জজকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারেন, সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে। শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশের ভূভাগে উন্নত জনজীবন, উন্নত জাতি ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলা। জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের মূলনীতি হবে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সর্বজনীন কল্যাণ।
৪. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা শেখার ব্যবস্থাকে যথাসম্ভব উন্নত করতে হবে। সারা দেশের সব শিশুকে বিদেশি ভাষা শেখানোর দরকার নেই।জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী সংখ্যা নির্ধারণ করে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও আরও কয়েকটি বিদেশি ভাষা ভালো করে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত কোনো রাষ্ট্রেই সব শিশুকে বিদেশি ভাষা শেখানো হয় না।