মেড ইন বাংলাদেশ: সম্ভাবনা নাকি শুভংকরের ফাঁকি
জার্মানির ফক্সওয়াগন বা বিএমডাব্লিউ গাড়ি অথবা সুইজারল্যান্ডের রোলেক্স হাতঘড়ি বিশ্বের বড় ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। এসব ব্র্যান্ডের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সুনামও ছড়িয়ে পড়েছে। দেশগুলোর এক ধরনের ব্র্যান্ড পরিচিতি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে কোম্পানিগুলো। কয়েকশ বছর আগেও ঢাকাই মসলিন কাপড় বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করত। আজ আর সেটি নেই। আধুনিক বৈশ্বিক বাজারে ব্র্যান্ডিং ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার। এর সঠিক যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে যেকোনো পণ্যের সুপরিচিতি গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে।
গত কয়েক বছর সরকার বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও দেশীয় পণ্যকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পণ্যের বাজারে আমাদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে ‘মেড ইন বাংলদেশ’ ট্যাগলাইন/স্লোগান প্রচার, প্রসার ও একে উৎসাহ দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের যদিও নেশন/কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের যাত্রা হয়েছিল কয়েক দশক আগে দেশের রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টরের হাত ধরে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পোশাক রফতানি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগটিকে এক নামে বৈশ্বিক ফ্যাশন বাজারে সমাদৃত করেছে। বিশ্বের সব ফ্যাশন মহারথী রিটেইলারের কাছে আজ বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের দক্ষ ও সুলভ শ্রম, উৎপাদন সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক মান, প্রতিযোগিতামূলক বাজারদর রেডিমেড গার্মেন্ট সেক্টরকে (আরএমজি) চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রফতানিকারকের জায়গা করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের লেদার ও ইলেকট্রনিক শিল্প নিজেদের দেশের চাহিদা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে এখন রফতানিও করছে। বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সামনে আরএমজি ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রডাক্টের বৈশ্বিক কেন্দ্র তৈরির সুযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে সরকারের বেশ কিছু নীতিনির্ধারণগত সিদ্ধান্তে বেশ কিছু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশেই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে। বর্তমানে বহু শিল্পের সেক্টর শুধু পণ্য অ্যাসেম্বল বা একত্রীকরণ করে মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগকে ব্যবহার করছে। কোনো পণ্য শুধু অ্যাসেম্বল করে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ ব্যবহার আদতে কতটা যৌক্তিক।
আরএমজি রফতানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিরকারক। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ আরএমজি সেক্টর প্রায় ১৫০ দেশে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক রফতানি করছে। এটা বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮০ শতাংশেরও অধিক। এজন্য আরএমজি বাংলাদেশের বিশ্ববাজারে মেড ইন বাংলাদেশ প্রডাক্টেরে মূল পরিচিতিকারক। আরএমজি বাদে বাংলাদেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পরিচয় বহনকারী আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। ২০২১-২২ অর্থবছরে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি মোট ১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারের রফতানি করে। বাংলাদেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে লেদার, লেদার ফুটওয়্যার এবং অন্যান্য লেদার জাতীয় পণ্যগুলো। ২০২১-২২ অর্থবছরে চামড়া শিল্প রফতানি থেকে আয় হয়েছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া বিভিন্ন কুটির শিল্প, পাট ও পাটজাতীয় পণ্য, জাহাজ, স্টিল, বাইসাইকেল, ফার্নিচার ইত্যাদি রফতানি করে যেমন প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে তেমনি একই সঙ্গে ‘মেড ইন বাংলদেশ’ পণ্যের সুনাম বাড়ছে।
বাংলাদেশ সরকারও দেশের বিভিন্ন শিল্প সম্প্রসারণ, আমদানির বিকল্প হিসেবে দেশীয় পণ্যের প্রসার ঘটানো, বাংলাদেশকে একটি উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা লক্ষ্যে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড তৈরিতে বদ্ধপরিকর। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের পণ্যকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতেই সরকার ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগটিকে কয়েক বছর ধরে ব্র্যান্ডিং করে আসছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া সিএনএনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মেড ইন বাংলাদেশ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মেড ইন বাংলাদেশ পণ্যকে বিশ্ববাজারে প্রচার ও প্রসারের কাজ করে চলছে।