দফার যেন দফারফা না হয়
আমাদের দেশের রাজনীতিতে ‘দফা’ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ‘ঐতিহাসিক ২১ দফা’সংবলিত। ওই ২১ দফায় পাকিস্তানি শাসক চক্রের শোষণ-নির্যাতনের হাত থেকে পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তির দিকনির্দেশনা ছিল।
ইতিহাস বিখ্যাত ২১ দফা রচনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ। তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যুক্তফ্রন্টের মতেও ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব-বাংলার ইতিহাসে একটা স্মরণীয় দিন। কাজেই ২১ ফিগারটাকে চিরস্মরণীয় করিবার অতিরিক্ত উপায় হিসাবে যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচিকে ২১ দফার কর্মসূচি করিলে কেমন হয়? ৪২ দফা কাটিয়া ২৮ দফা করা গেলে ২৮ দফাকে কাটিয়া ২১ দফা করা যাইবে না কেন? নিশ্চয়ই করা যাইবে। তাই করিলাম।
অতঃপর আমার কাজ সহজ হইয়া গেল। ইতিহাস বিখ্যাত ২১ দফা রচনা হইয়া গেল।’ (পৃষ্ঠা ২৪৫, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৮৪)। এ দেশের মানুষ যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে তাদের মুক্তিসনদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় অর্জিত হয়েছিল। যদিও নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তে যুক্তফ্রন্ট সরকার বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপন করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। ওই বছরই ১৮-১৯ মার্চের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফায় পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক মুদ্রাব্যবস্থাসহ বর্তমান বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। বলাই বাহুল্য, ছয় দফা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পছন্দ হয়নি। তারা এর মধ্যে পাকিস্তান ভাঙার গন্ধ আবিষ্কার করে। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়; যা ইতিহাসে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে খ্যাত। ওই সময় আরও দুটি দফা জনপ্রিয় হয়েছিল। একটি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা এবং মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ১৪ দফা। ছয় দফাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রদ্রোহ বলে প্রচার করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সেটাকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেছিল। মূলত সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের মূল প্রতিপাদ্যই ছিল ছয় দফা; যার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা।