ভালো রেজাল্ট: দুশ্চিন্তার অন্য নাম

দৈনিক আমাদের সময় ইকবাল খন্দকার প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর ২০২২, ১৬:০০

একটা ভালো রেজাল্ট আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয় পুরো বাড়িতে। আর এই বন্যা স্থায়ী হয় তিন থেকে সাত দিন। এর পর থেকেই শুরু হয় দুশ্চিন্তা। সে দুশ্চিন্তার অশুভ সূচনা এই প্রশ্ন থেকে- ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ হবে তো? যাদের রেজাল্ট ভালো হয় না অথবা মোটামুটি মানের হয়, এই দুশ্চিন্তা তাদের স্পর্শ করে না। গ্রামের কলেজ বা শহরের নামসর্বস্ব কোনো একটা কলেজে ভর্তি হয়ে তারা পার করার চেষ্টা করে শিক্ষাজীবনের বাকি ধাপগুলো। কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা থাকে না। তাই কোনো চাপও থাকে না। বিশেষ কোনো স্বপ্ন থাকে না। এ জন্য স্বপ্ন ভাঙা কিংবা পূরণ না হওয়ার বেদনাও থাকে না। অথচ যারা ভালো রেজাল্ট করে, বেদনা আর দুশ্চিন্তা তাদের পিছু ছাড়ে না। রেজাল্ট ভালো হয়েছে, অতএব ভালো কলেজে ভর্তি না হলে চলে? এই যে প্রশ্ন, এই যে প্রত্যাশা, মতান্তরে উচ্চাকাক্সক্ষা- এসব তাদের ভালো থাকতে দেয় না। এটাই স্বাভাবিক- ভালো রেজাল্ট করলেও সবাই ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে না। কিন্তু এ স্বাভাবিক ব্যাপারটি মেনে নিতে পারে না অনেক কোমলমতি শিক্ষার্থী। এতে অতিমাত্রায় হতাশ আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলে কেউ কেউ। আবার অনেকে এই হতাশা আর দুশ্চিন্তার চাকায় এমনভাবে পিষ্ট হয় যে, তাদের আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয় না। তারা হয়তো বই নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে।


তবে মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। ফলে পরবর্তী পরীক্ষাগুলোয় ভালো রেজাল্ট আর করা হয় না। অনেকে ফেল করেও বসে। হতাশা কাটাতে নেশার জগতে চলে যায় কেউ কেউ। ধরা যাক, এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট হলো। প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো কোনো কলেজে ভর্তিরও সুযোগ হয়ে গেল। তাতেই কি শিক্ষাজীবন এমন কোনো গন্তব্যে পৌঁছে যায়- যেখানে কোনো দুশ্চিন্তা বা হতাশা নেই? অবশ্যই না। কারণ শিক্ষাজীবনের পরের ধাপগুলো আরও কঠিন, আরও প্রতিযোগিতামূলক। বলছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধের কথা। যে ছেলে বা মেয়ে আজ ভালো রেজাল্ট করল, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। এই লক্ষ্যে পৌঁছানো আগে যতটা কঠিন ছিল, এখন এর চেয়ে বহুগুণ বেশি কঠিন। কারণ একটাই- এখন ভালো রেজাল্টধারীদের সংখ্যা বেশি। একটা সময় ছিল- যখন পাস করতে পারলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যেত। কেননা তখন পাস করাটাই কঠিন ছিল। সর্বোচ্চ যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই পাস করতে হতো। আর এ প্রমাণই বলে দিত- তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্য। এর পর যখন ভালো রেজাল্ট অনেকটা সহজলভ্য হয়ে গেল, তখন দেখা গেল অযোগ্যরাও গোল্ডেন ‘এ প্লাস’ পেয়ে বসে আছে। ‘অযোগ্য’ শব্দটা আপত্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কে যদি খোঁজখবর নেওয়া হয়, তা হলে একদমই আপত্তিকর মনে হবে না। ভাবা যায়, অনেক ভর্তিচ্ছু পাসই করতে পারে না ভর্তি পরীক্ষায়! বিশেষ করে ইংরেজিতে। এসএসসিতে ঈর্ষণীয় রেজাল্ট, এইচএসসিতে ঈর্ষণীয় রেজাল্ট। অথচ ভর্তি পরীক্ষায় পাসই করতে পারে না বা টেনেটুনে পাস করে। এমতাবস্থায় ‘অযোগ্য’ শব্দটা কি আপত্তিকর মনে হওয়া উচিত? তবে সবাই এমন ‘অযোগ্য’ নয়, অনেকেই যোগ্য। হাজার হাজার শিক্ষার্থী যোগ্য- যারা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আর দীর্ঘ সময় ব্যয় করে অতিক্রম করে উচ্চশিক্ষার চূড়ান্ত ধাপ। তখনই শুরু হয় প্রকৃত যুদ্ধ। সে যুদ্ধ জীবিকার, সে যুদ্ধ সংসারের হাল ধরার যোগ্যতা অর্জনের। কিন্তু অধিকাংশ ‘যোদ্ধা’ই ব্যর্থ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। হ্যাঁ, প্রতিটি যুদ্ধেই জয় আছে, পরাজয় আছে; সফলতা আছে, ব্যর্থতা আছে। কিন্তু ভালো রেজাল্ট করা একজন ছাত্র যখন জীবনের চূড়ান্ত যুদ্ধে মুখ থুবড়ে পড়ে, ব্যর্থ হয়, চাকরির জন্য ঘুরে ঘুরে জুতার তলা ক্ষয় করে জুতা বদলায় অথচ জীবন বদলাতে পারে না- তখন আশপাশের মানুষজন কটু কথা শোনাতে ছাড়ে না। আর তাদের সেই কটু কথার একটাই সারমর্ম থাকে- ‘ছাত্রজীবনে এত ভালো রেজাল্ট করে লাভটা হলো কী?’ তার মানে, ভালো রেজাল্ট যখন বেকারত্বের চাপ বাড়ায়, তখন সেটি হয় আরও ভয়াবহ। মানুষ অনেক কিছুই মেনে নেয়। কিন্তু কোনো মেধাবী ছাত্র পড়াশোনা শেষ করে বেকার ঘুরবে- এটা মেনে নিতে পারে না। বলে রাখা ভালো, এখানে ‘মেধাবী’ শব্দটা ব্যবহার করা হলেও প্রকৃত মেধাবীরা কখনই বেকার বসে থাকে না- যার হাজারটা প্রমাণ দেওয়া যাবে, উদাহরণ দেওয়া যাবে। তাই সন্দেহের তীরটা তাদের দিকেই যায়- যারা শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন ধাপে ভালো রেজাল্ট করে। এমন সন্দেহ- সত্যিই কি ভালো ছাত্র? নাকি মুখস্থবিদ্যা উগরে দিয়ে কেবল ভালো রেজাল্ট করেছে? এই সন্দেহ, এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়ে উঠছে সময় ও বাস্তবতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কথা ছিল এমন হওয়ার- যে ছাত্র এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছে, এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছে, অনার্স-মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করেছে; চাকরির জন্য তার আর ইন্টারভিউয়েরই দরকার নেই।


তাকে সরাসরি চাকরি দিয়ে দাও। তাও এমন বেতনে- যে বেতন পেলে কারও মাথায় আর দুর্নীতি করে ওপরি রোজগারের চিন্তা ঢোকে না। অথচ দিন দিন পরিস্থিতি কেবল কঠিনই হচ্ছে। তাই গোল্ডেন এ প্লাসের বাম্পার ফলন আমাদের জন্য বিশেষ কোনো আনন্দ নিয়ে আসে না। আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না, বিশ্বাস করতে পারি না- যে ছেলে বা মেয়ে আজ উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো রেজাল্ট করল, সে পুরো জীবনই কাটাতে পারবে উচ্ছ্বাস ও আনন্দে। এমনটা বলতে না পারা কিংবা বিশ্বাস করতে না পারার কী কারণ, তা তো বললামই। আর না বললেও সবার বুঝতে পারার কথা বেকারের সংখ্যা দেখে, বেকারত্বের চাপ দেখে। প্রশ্ন আসতে পারে- তা হলে কি ছেলেমেয়েরা ভালো রেজাল্ট করবে না? অবশ্যই করবে। ভালো রেজাল্ট তো করতেই হবে। তবে এ ভালো রেজাল্টের আনন্দ যেন কেবল মিষ্টি বিতরণেই সীমাবদ্ধ না থাকে; বরং এ আনন্দকে কীভাবে আজীবনের আনন্দের উপলক্ষ করা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। মোট কথা, আপনার সন্তান যতটা ভালো রেজাল্ট করেছে- যাচাই করুন সে ততটা যোগ্য কিনা। যদি যোগ্য না হয়, তা হলে যোগ্য করে তুলতে যা যা করা প্রয়োজন- সব করুন। এতে শিক্ষাজীবনের পরের ধাপগুলো অতিক্রম করতে তাকে আর বেগ পেতে হবে না, বেগ পেতে হবে না বেকারত্বের শাপ এবং চাপ থেকে বের হয়ে আসতেও। সে বুঝবে জীবন সুন্দর, বুঝবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ততটাই আনন্দমময়- যতটা আনন্দময় ভালো রেজাল্টের পর মিষ্টি বিতরণের মুহূর্তটা।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও