বিশ্বকাপে ইরানের জাতীয় সংগীত না গাওয়া কেন যৌক্তিক
বিশ্বকাপ ফুটবলের ‘বি’ গ্রুপের ম্যাচে ইংল্যান্ড ও ইরানের প্রথম খেলাটি ছিল ২১ নভেম্বর। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে প্রতিযোগী দুই দলের জাতীয় সংগীতের মিউজিক বাজিয়ে খেলা শুরু হয়। সেদিনও যথারীতি ইংল্যান্ডের এবং ইরানের জাতীয় সংগীতের যান্ত্রিক মূর্ছনাটি বাজানো হয়। কিন্তু ইরান দলটির একজন খেলোয়াড়ও গানটির সঙ্গে ঠোঁট মেলাননি। ইরানের অধিনায়ক আলি রেজা জাহানবখশ ফিফাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন ইরান দলের খেলোয়াড়েরা জাতীয় সংগীত গাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। কারণ সহজবোধ্য। উদ্দেশ্য ইরানের সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা প্রদর্শন। অক্টোবরে পুলিশি হেফাজতে মাসা আমিনি নামের ২২ বছর বয়সী এক তরুণীর মৃত্যু ঘটে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ইসলামিক রিপাবলিকের পোশাকবিধি ভঙ্গ করেছেন। তেহরান থেকে গ্রেপ্তারের তিন দিন পরই আমিনির মৃত্যু হয়। তারপর থেকে বিক্ষোভে উত্তাল ইরান। বেসরকারি হিসাবমতে, অন্তত ৩৮০ জন ইরানি আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন। দুজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোই শুধু নয়, বিশ্ববাসীও ইরানের মানবাধিকার লঙ্ঘন-কাণ্ডের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে। স্বদেশে দমন-পীড়নের মাঝেও আন্দোলনটি দ্বিতীয় মাসে গড়িয়েছে। বিষয়টি অভূতপূর্ব।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে খেলাটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল। জাতীয় সংগীতে ঠোঁট না মেলানো অংশটুকু টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সেন্সর করে দেয়। তবু ইরানে যেমন, ইরানের বাইরেও বিষয়টি বড়সড় বিতর্ক তৈরি করেছে। খেলোয়াড়দের জাতীয় সংগীত না গাওয়া উচিত হয়েছে কি হয়নি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক চলছে। কিন্তু উচিত-অনুচিত ভাবনাটিকে দূরে সরিয়ে রাখা দরকার। কারণ, তাতে অনায়াসে রায় দিয়ে ফেলা হয়। জনগণ হয় সাদা নয় কালো ধরনের দুটি ভাবনা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার বদলে দেখা দরকার ইরানি খেলোয়াড়দের এই সম্মিলিত নীরব প্রতিবাদ হতে আমরা কী শিখতে পারি। বুঝতে চেষ্টা করি নীরব প্রতিবাদটি বিশ্ববাসীকে কোন বার্তাটি দিচ্ছে।
ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো বটেই, আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনেও বিষয়টি নিয়ে কমবেশি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছেই। বিশ্লেষণ ও মতামতগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। আজ পর্যন্ত নজরে আসা বয়ানগুলোর একটি তালিকা দিই। এক. জাতীয় সংগীত দেশের স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের চিহ্ন-শাসনসংগীত কিংবা শাসকসংগীত তো নয়। শাসক দলের দলীয় সংগীতও নয়। সেই বিচারে জাতীয় সংগীত না গাওয়া সরকার বিরোধিতা হয়নি, রাষ্ট্র বিরোধিতা হয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রের জনগণই জাতীয় সংগীতের মালিক, ‘সরকার’ নামের ক্ষুদ্র বর্গটি নয়। দুই. খেলোয়াড়েরা সরকারের নয়, দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। স্বদেশের অর্থ খরচ করে প্রস্তুতি নিয়েছেন। খেলতে এসেছেন স্বদেশের অর্থায়নে। স্বদেশের বিমানে চড়ে এসেছেন। স্বদেশের জার্সি বাদ দেননি, পতাকা দেখানোয়ও বাদ সাধেনননি। তাহলে জাতীয় সংগীত কী দোষ করল? তিন. তাঁদের মূল দায়বদ্ধতা দেশের সব নাগরিকের প্রতি। কারণ, তাঁদের দেওয়া করের অর্থ ব্যবহার করেই তাঁরা বিশ্বকাপে খেলার যোগ্য হয়েছেন। সুতরাং তাঁদের প্রতিবাদটি গণবিরোধী হয়েছে বটে সরকারবিরোধী হয়নি। চার. জাতীয় সংগীত সার্বভৌমত্বের প্রতি গভীর সম্মান, মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধের স্মারক। তাঁদের কাণ্ডটির মাধ্যমে জাতীয় সংগীতের অবমাননা, অসম্মান-অমর্যাদা, অশ্রদ্ধা—সবই হয়েছে। কট্টরপন্থীদের মতে, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত অবমাননাকারীরা দেশদ্রোহের শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।