দুজনেই আওয়ামী লীগের কিন্তু দুভাবে
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬), দুজনেই আওয়ামী লীগের নেতা, কিন্তু দুজন দুভাবে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকায়; সোহরাওয়ার্দী তখন এর সঙ্গে মোটেই যুক্ত ছিলেন না। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হচ্ছেন ভাসানী। সোহরাওয়ার্দী পরে এসেছেন; এবং আওয়ামী লীগের জোরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে দলের প্রধান নেতায় পরিণত হয়েছেন, আত্মজীবনীতে তিনি বারবার বলেছেন, ‘ওটি আমার দল’। তার প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে, এবং কারণে, আওয়ামী লীগ দ্বিখ-িত হয়েছে; ১৯৫৭ সালে ভাসানী বের হয়ে গিয়ে ন্যাপ গঠনে বাধ্য হয়েছেন, এবং ন্যাপ পরিণত হয়েছে সারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংগঠনে, যেটি আওয়ামী লীগের পক্ষে হওয়া সম্ভব হয়নি।
সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানীর বিরোধ আসলে অবধারিত ছিল; কারণ তাদের রাজনীতি মোটেই অভিন্ন ছিল না। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী, তার আন্তরিক চেষ্টা ছিল পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার। অপরদিকে ভাসানী ছিলেন পুরোপুরি বাঙালি জাতীয়তাবাদী; এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই তিনি বুঝে ফেলেছিলেন যে এই রাষ্ট্র তার স্বপ্নের পাকিস্তান নয়, এটি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তান বটে। বুঝেছিলেন যে এই রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে নতুন একটি ‘গোলামি’র শৃঙ্খলে বেঁধে রাখতে চাইবে এবং এখানে মেহনতি মানুষের পক্ষে মুক্তি অর্জন অসম্ভব হবে। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ যে দ্বিখ-িত হয় তার পেছনে ছিল দুই পরস্পরবিরোধী জাতীয়তাবাদের বিকাশমান দ্বন্দ্ব; পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের। ভাসানী-তো প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছিলেন যে শোষণ-বঞ্চনা চলতে থাকলে বাঙালিরা পাকিস্তানকে ‘আসসালামো আলাইকুম’ জানাতে বাধ্য হবে।
কথাটা তিনি ব্যক্তিগতভাবেও বলতেন। কাগমারী সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে সাহিত্যিক অতিথিরা এসেছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়; তারাশঙ্কর স্মরণ করেছেন যে ভাসানী তাকে বলেছিলেন যে দেখবেন পাকিস্তান টিকবে না; দশ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়ে যাবে। তারাশঙ্কর কথাটা বলেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়কে। শুনে অন্নদাশঙ্কর চমকে উঠেছেন; বলেছেন, ‘খবরদার এ কথা আর কাউকে বলবেন না। জানতে পারলে মওলানাকে পাকিস্তানের শাসকরা বাঁচতে দেবে না।’ এই ঝুঁকিটা ছিল, তবু কথাটা তিনি বলেছেন। আর ঠিক দশ বছরে না হলেও চৌদ্দ বছরে পূর্ববঙ্গ ঠিকই স্বাধীন হয়েছে; যাতে ভাসানীর ভূমিকা ছিল ধারাবাহিকভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ।
দুই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পার্থক্যের সঙ্গে জড়িত ছিল দুটি পৃথক ধরনের রাজনীতি। একটি বুর্জোয়াদের, অপরটি মেহনতিদের। এটা মোটেই তাৎপর্যহীন নয় যে, ভাসানী যখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে, ঠিক সেই সময়েই সোহরাওয়ার্দী যুক্ত হন ‘জিন্নাহ আওয়ামী লীগ’ গঠনে। সত্য এটাই যে, সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রধান নেতা জিন্নাহর রাজনীতি থেকে মৌলিকভাবে পৃথক ছিল না; এবং সে বিচারে আইয়ুব খানের রাজনীতির সঙ্গেও তার রাজনীতির পার্থক্যটা যে একেবারে মৌলিক তা নয়। সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহর নেতৃত্বে প্রায় অভিভূতই ছিলেন; জিন্নাহর নির্দেশে তিনি লাহোর প্রস্তাবের মারাত্মক রকমের ক্ষতিকর সংশোধনী প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন; যদিও জিন্নাহ যে সোহরাওয়ার্দীকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন এমন প্রমাণ পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায়নি। আইয়ুব খানের সঙ্গে অবশ্য সোহরাওয়ার্দীর বন্ধুত্বের আপাতগ্রাহ্য কোনো কারণ ছিল না, কিন্তু একই মন্ত্রিসভায় কাজ করতে দুজনের কারোই আপত্তি দেখা দেয়নি। মিল ছিল শ্রেণিগত অবস্থানে; এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।