কর্ণফুলীর কান্না কেউ শুনতে পায় না
নদী কি কাঁদে? কোনো কোনো কবিতায় নদীর কান্নার কথা পাওয়া যায়। আমাদের বাংলাদেশের গানে শুনেছি ‘নদীও নারীর মতো কথা কয়’। কবিরা সত্যদ্রষ্টা। তাঁরা নদীর কান্নার কথা শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর যে নদীর তীরে শত শত বছর ধরে গড়ে উঠেছে, সেই কর্ণফুলীর কান্না শুনতে এখন আর কবির প্রয়োজন পড়ে না। যেকোনো মানুষ একে দেখলে তার কান্নার ধ্বনি হৃদয়ে অনুভব করেন। মনে হয় মৃত্যুশয্যায় শুয়ে একটি নদী ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে ওঠা তার প্রবাহকে বাঁচানোর আর্তনাদ করে যাচ্ছে। অথচ কেউ শুনছে না। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি বিখ্যাত গান—‘ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাক্কিলাম তোরে’। এই গানে এক বিরহিনী জীবনের করুণ কাহিনির কথা কর্ণফুলীকে সাক্ষী রেখে বয়ান করতে থাকে।
কর্ণফুলী আসলেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশার যেমন সাক্ষী, তেমনি মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা, দস্যুতা, দখলদারিসহ নানা অপকর্মের সাক্ষী হয়ে আছে। কর্ণফুলী এখন মৃত্যুশয্যায়। অতীতের সব সময় থেকে বর্তমানে এই নদী সবচেয়ে বেশি দখলের শিকার। গুগল ম্যাপে ফিরিঙ্গিবাজার ফেরিঘাট থেকে কর্ণফুলী শাহ আমানত ব্রিজ পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকায় ভরাট ও দখলের সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন এ বছর মার্চ ও এপ্রিলে বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম ও পরিবেশবাদী সংগঠন সৃষ্টির সহযোগিতায় কর্ণফুলীর তলদেশের গভীরতা ও দখল নিয়ে একটি জরিপ চালায়।
গত ৯ এপ্রিল ম্যানুয়ালি এবং ২৩ এপ্রিল আধুনিক ফ্যাদোমিটারের মাধ্যমে ভাটার সময় নদীর তলদেশের গভীরতা পরিমাপ করা হয়। এই পরিমাপে দেখা যায় চাক্তাই খালের মোহনায় উত্তর পাশে কর্ণফুলীর প্রকৃত সীমানা থেকে তিন শ ফুট নদীর অংশে গভীরতা মাত্র ২ ফুট। মাঝনদী বরাবর ১৩ দশমিক ৬ ফুট, দক্ষিণ পাড়ে তীরের কাছাকাছি গভীরতা ৪৮ ফুট। এর ৫০০ ফুট উজানে রাজাখালী খালের মোহনায় মাঝনদীতে গভীরতা মাত্র ৪ ফুট। শাহ আমানত ব্রিজের উত্তর পাশে ১ ও ২ নম্বর পিলারের মধ্যখানে গভীরতা ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার পরিমাপ অনুযায়ী থাকার কথা ২৫ ফুট। সেখানে বর্তমান গভীরতা হচ্ছে ৭ দশমিক ৭ ফুট। মূলত এই ২ ও ৩ নম্বর পিলারের মাঝখানে চর জেগেছে। এই চরের কারণে নদীর প্রশস্ততা কমছে। ২০০০ সালে এই এলাকায় কর্ণফুলীর প্রশস্ততা ছিল ৯৩০ দশমিক ৩১ মিটার। বর্তমানে এখানে পানির প্রবাহ ৪১০ মিটারে এসে ঠেকেছে। কী রকম দ্রুত সংকুচিত হয়ে পড়ছে, তা শুধু এই ছোট পরিসংখ্যানে অনুমান করা যায়। নদীর ভরাট হওয়া ঠেকাতে ২০১৮ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩২১ কোটি টাকার ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এ বছর মে মাসে সেই কাজ শেষ হলো। ক্যাপিটেল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ কিন্তু কর্ণফুলীর তিন বর্গকিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে বিরাট চর জেগেছে।