মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের কী করা উচিত
প্রায় এক মাস ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পার্বত্য অঞ্চলে রাখাইন আর্মি ও মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধের জেরে কয়েক দিন ধরে সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশের সীমান্তের শূন্যরেখা বরাবর ভারী অস্ত্রের গোলা এসে পড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে পাহাড়ের পাদদেশের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে মর্টার শেল এসে পড়লে ছয়জন রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন। আহত মো. ইকবাল নামে এক কিশোরের পরে মৃত্যু হয়। সেদিন সন্ধ্যা থেকে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপ শুরু হয় এবং তা ভোর ৪টা পর্যন্ত চলে। তাতে ওই এলাকার মানুষের ভেতর তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরও তিন দিন আগে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে রকেট শেল ছুড়লে ওই শেল বাংলাদেশের ভূখ-ে এসে পড়ে। মিয়ানমারের হেলিকপ্টার ও ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বলে অভিযোগ উঠলে বাংলাদেশে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। সর্বশেষ ঘটনায় কিশোর ইকবালের মৃত্যু হলে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। মিয়ানমার কোনো দিন কথা দিয়ে কথা রাখে না। আমাদের পক্ষ থেকে না হয় জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ করব।’ সীমান্তের ওপারে রাখাইন আর্মি ও মিয়ানমার বাহিনীর মধ্যে এই তুমুল লড়াইয়ের জন্য যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মানুষ খুব উদ্বিগ্ন জীবনযাপন করছেন। কৃষকরা মাঠে যেতে পারছেন না। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে পারছে না। চারদিকেই আতঙ্কজনক পরিবেশ বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ ভূখ-ে মর্টারের যে গোলা এসে পড়েছে তা ৮২ মিলি মিটার মর্টারের গোলা বলেই মনে হয়েছে। ৮২ মিলি মিটার মর্টার থেকে গোলা ছোড়া হলে সে গোলা সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৮০ মিটার পর্যন্ত যেতে পারে। সে হিসেবে বলা যায়, দুই থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই গোলা কারা নিক্ষেপ করেছে? আরাকান আর্মি না মিয়ানমার বাহিনী? তবে হেলিকপ্টার থেকে যে রকেট শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সেই হেলিকপ্টারটি মিয়ানমার বাহিনীরই ছিল। কারণ আরাকান আর্মির কোনো হেলিকপ্টার নেই। মিয়ানমারের এই হেলিকপ্টার বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছেই আরাকান আর্মির কোনো অবস্থানের ওপরই হয়তো গোলাবর্ষণ করেছে। সে হিসেবে বলা যায়, সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে দু-তিন কিলোমিটার অভ্যন্তর এলাকা জুড়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার বাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ চলছে। সীমান্ত এলাকায় যদি এরূপ বড় ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে এর ঝঢ়রষষড়াবৎ ঊভভবপঃং সীমান্তের এপারে আসতেই পারে। এ ক্ষেত্রে, তারা ইচ্ছে করে বাংলাদেশ ভূখন্ডকে লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করেছে বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না। বরং তাদের মধ্যে গোলা বিনিময়কালে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ডে এসে গোলা পড়েছে বলেই মনে হয়েছে।
মিয়ানমারে বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে মনে হয়, রাখাইন রাজ্যটি মিয়ানমার থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে। তবে কখন কীভাবে হবে তা এখন দেখার বিষয়। এ ব্যাপারে আরাকান আর্মি প্রধান জেনারেল তোয়াই ম্রা নাইংয়ের বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া বক্তব্যই যথেষ্ট। তিনি দাবি করেছেন, রাখাইনের ৬০ শতাংশের বেশি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তারা এরই মধ্যে ওইসব এলাকায় তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বলেও তিনি দাবি করেন। বিচারব্যবস্থা ও কর ব্যবস্থাপনাও তৈরি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তারা নতুন পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণও পরিচালনা করছেন। তার বক্তব্যের পঞ্চাশভাগও যদি সত্য হয়, তাহলে বলা যায়, রাখাইনের ওপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের আগের মতো আর নিয়ন্ত্রণ নেই। এ কারণে মিয়ানমার বাহিনী, রাখাইনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এসব কিছু মিলিয়ে, গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার বাহিনীর একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে চলেছে।