ছোট পোশাকের বড় গল্প
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাংলাদেশের সংবিধানপ্রদত্ত সব নাগরিকের সমান অধিকার কায়েমের জন্য আশির দশকের শেষের সময় থেকে যখন আমরা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করে নারীর সমানাধিকার, সমান মর্যাদা এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম’-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, তখন আমাদের নারীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগ করা হতো যে, আমরা এ দেশের কালচার নষ্ট করছি। তার সঙ্গে আরেকটি অভিধা দেওয়া হতো যে, আমরা ‘পশ্চিমা শিক্ষা’য় শিক্ষিত। আমাকে মাঝে মাঝে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে জিজ্ঞেস করত আমি নারীবাদী কি না। আমি উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বললে তারা বলত, ‘আপনি তাহলে ব্রা পরেন কেন? নারীবাদীরা তো ব্রা পরেন না।’ এর উত্তরে আমি তাদের বলতাম, ‘আমাদের দেশে অনেক নারী, বিশেষ করে গ্রামে বসবাসকারী আমার নানি-দাদিসহ আগের প্রজন্মের নারীরা কখনো ব্রা পরতেন না। আপনার কথা অনুযায়ী তারা তো তাহলে আরও বেশি নারীবাদী।’
সরকারি অফিস-আদালতে গেলে, সচিব-উপসচিব পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও শোনা যায় যে ‘পশ্চিমা শিক্ষা’য় শিক্ষিত হয়ে আমরা নারীবাদীরা এ দেশের সংস্কৃতি-কালচার নষ্ট করে দিচ্ছি। তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় যে তারা কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেছেন তাহলে তারা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলেন। তা ছাড়াও, অনেকে পশ্চিমা দেশের অনেক বিশ^বিদ্যালয়ের নাম সগর্বে বলেন। আমি তাদের বলি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েছি, তাহলে তারা ‘পশ্চিমা শিক্ষা’য় শিক্ষিত না হলে আমরা হব কেন? আমলারা যে প্যান্টশার্ট পরে অফিসে আসেন, সেটা কি আমাদের কালচার? প্যান্টশার্ট পরা তো ব্রিটিশদের থেকে শিখেছি। ওদিকে হিজাব-বোরকা বাংলাদেশের পোশাক কীভাবে হলো? আমি তো শাড়ি পরছি, বাংলাদেশের সংস্কৃতি তো আমরাই রক্ষা করছি। এসব প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে তারা অন্যভাবে দাপট দেখান তথা অভদ্র আচরণ করেন।
সম্প্রতি নরসিংদী রেলস্টেশনে এক তরুণীকে পোশাকের কারণে হেনস্তা হতে হয়েছে, অশ্লীল আচরণের মুখোমুখি হতে হয়েছে, এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন, পত্রিকায় লেখালেখি, এমনকি এক নারীকে গ্রেপ্তারও করা হলো। কোর্টে জামিন শুনানিতে বিচারক বললেন, ‘সভ্য দেশে এমন পোশাক পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি না?’ এ নিয়েও আলোচনার শেষ নেই। নারীদের পোশাক প্রশ্নে এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করা জরুরি। পোশাক নিয়ে কথা বলবার সময় শাড়ি বা হিজাবের খরচ এবং টিশার্ট ও জিন্সের খরচের বিষয়টিও আমাদের চিন্তার মধ্যে রাখতে হবে। এখন বিভিন্ন খাতে খরচ কমানোর প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু খরচটা কোন জায়গা থেকে কমানো হবে, খাবারের খরচ থেকে নাকি পোশাকের? মনে পড়ে, পাকিস্তান আমলে আদমজীতে শাড়ি পরে কাজ করার সময় মেশিনে শাড়ি আটকে একজন নারী শ্রমিকের হাত কাটা পড়েছিল। তখন আমরা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ি। সে সময় আমরা আন্দোলন করে দাবি তুলেছিলাম যে, কারখানায় কাজ করার জন্য নারী-পুরুষ সব শ্রমিককে কারখানার উপযোগী পোশাক দিতে হবে। শ্রমিকের নিরাপত্তার স্বার্থেই এটা হওয়া প্রয়োজন। কারণ সব কাজের জন্য সব পোশাক উপযুক্ত না। যেমন পুলিশে, আর্মিতে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়। খেলাধুলার সময় নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়। তেমনি বাসে, রিকশায়, মোটরসাইকেলে ভ্রমণের সময়ও নিরাপত্তা ও শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের কথা বিবেচনা করে নারীদের জিন্স-টিশার্টের নির্বাচন খুবই যৌক্তিক হতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নারীর পোশাক
- হেনস্তার শিকার