নজরুল-পাঠের সনাতন ধারা ও সীমাবদ্ধতার দুটি দিক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারাক্রমের মধ্যে নজরুলকে জুতমতো আঁটানো যায় না। বয়সে প্রায় তার সমকালীন, কিন্তু এক দশক পরে বিকশিত, ‘আধুনিকতাবাদী’ কবিদের প্রবল প্রতাপ এবং বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে আধুনিকতাবাদের প্রবল প্রতিষ্ঠা নজরুল-পাঠে বেশ নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এই সংকট সত্ত্বেও নজরুল বাংলা ভাষার অতি-আলোচিত সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বই বটে।
এসব আলোচনায় সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথ ও তিরিশি কবিতার মূল অনুমানগুলোর ধারাবাহিকতার মধ্যেই নজরুলের কবিতা পঠিত হয়েছে। তাতে এই কাব্যলোকের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিশিষ্টতা জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান দিকগুলো এভাবে সূত্রায়িত করা যায়—
এক. সাধারণভাবে নজরুলকে চেনা হয় রোমান্টিক কবি হিসেবে। সেই রোমান্টিকতার এক পাশে বিদ্রোহ, অন্যদিকে প্রেম ও প্রকৃতি।
দুই. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তিরিশি কবিদের মধ্যবর্তী জায়গায় তার স্থান। আর এই স্থানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার কিংবা যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের তুলনায় তার গুরুত্ব অনেক বেশি।
তিন. বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র-প্রভাব অতিক্রমে নজরুল খুব বড় ভূমিকা রেখেছেন ‘অলস শব্দসুষমা’র বিপরীতে বীরত্বব্যঞ্জক গতি-প্রবাহ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
চার. নজরুল ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের কবি এবং ‘ঔপনিবেশিক সমাজে সংগ্রামী কবি’।
পাঁচ. নজরুল নিম্নশ্রেণির মানুষের প্রতি দরদি কবি-ব্যক্তিত্ব। বাংলা কবিতার সীমাকে তিনি এদিক থেকে প্রসারিত করেছেন।
ছয়. নজরুল গভীরভাবে মানবতাবাদী কবি; তার সমগ্র উচ্চারণ এবং কর্মপ্রবাহ এক গভীর মানবতাবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত।
সাত. নজরুল বাংলা কাব্যের ধারায় একজন বড় কবি। বাংলা কবিতার শব্দ মুদ্রায় ও ছন্দে তার সুস্পষ্ট অবদান রয়েছে। তার কাব্যস্বর পৃথক ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
উত্তরকালীন কবিতার অন্তত তিনটি প্রধান ধারায়—ইন্দ্রিয়জাগর উচ্চারণে, সাম্যবাদী-মার্কসবাদী কবিতায় এবং ইসলাম চেতন কবিতায়—বিপুল প্রভাব তার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই তালিকা আরও বাড়ানো যায়। তবে, সাধারণভাবে বাংলা কাব্যের ধারাবাহিকতার মধ্যে থেকে নজরুল-সাহিত্যকে যারা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের আলোচনার প্রধান সূত্রগুলো এতে পাওয়া যাবে।
সূত্রগুলো মূল্যবান; কারণ, এগুলোর ভিত্তিতে সহজেই দেখানো সম্ভব, নজরুল ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতার প্রধান চার কবির অন্যতম। কিন্তু, এই সূত্রগুলো নজরুল-বিবেচনায় পুরোপুরি যথার্থ নয়, যথেষ্ট তো নয়ই।
তার প্রধান কারণ, এসব সূত্রে মান্য করা হয়েছে প্রতিষ্ঠিত-প্রভাবশালী নানা ছক—একদিকে ইউরোপের নন্দনতত্ত্বের যে ছকগুলো উপনিবেশিত কলকাতায় চর্চিত হয়েছে সেই সব ছক; অন্যদিকে, ঔপনিবেশিক কাঠামোর একটা সংকীর্ণ শ্রেণিভিত্তির মধ্যে জন্ম নেওয়া, বিকশিত হওয়া সব নন্দনতাত্ত্বিক কাঠামো। এখানে কেবল দুটি ছকের উদাহরণ দেওয়া হলো, যেগুলো হরহামেশাই নজরুলের ক্ষেত্রে আরোপ করা হয়, অথচ এসব ছাঁচে নজরুলকে কেবল অতি-আংশিকভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
প্রথমটি রোমান্টিকতার ছক। রোমান্টিক আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল ইউরোপের এক বিশেষ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে, যার মূল কথা হলো সুদূরের আবাহন এবং রহস্যের আবেষ্টন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কবিতা
- কবি
- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম