এ দায় আমরা এড়াতে পারি না
স্বাভাবিক মনে করা যাবে না। কদিন পরপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কোনো নাম গোত্রহীন কেউ ফেসবুকে ধর্ম অবমাননা করেছে, পবিত্র কুরআন অবমাননা করেছে, মহানবির প্রতি কটূক্তি করেছে। আর এর প্রতিবাদে জুমার নামাজের পর এক দল জেহাদি মনোভাবের মুসলমান নামধারী মানুষ মসজিদ থেকে বেরিয়ে পবিত্র কুরআন আর রাসূলের শিক্ষাকে অমর্যাদা করে হিন্দু বসতিতে আগুন দিচ্ছে, লুটতরাজ করছে। কখনো রামুতে ঘটছে, কখনো নাসিরনগরে আবার কখনো লোহাগড়ায়।
ভাবতে অবাক লাগে, হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়া এ বাংলার সমাজে সামান্য ঐতিহ্যচর্চার সুযোগও দেখাতে পারছে না এসব ধর্মীয় লেবাসধারী। আমার কাছে স্পষ্ট নয় যে, ইসলামের মতো এমন জীবন্ত ধর্ম-যে ধর্ম তার স্থিতিস্থাপকতার আদর্শের কারণে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে কে ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ বা মহানবিকে কটূক্তি করল তাতে কী আসে যায়! ধর্মের কতটা ক্ষতি হয় তাতে? এসবকে উপেক্ষা করতে পারি না কেন? ধর্ম রক্ষার নামে এরা সব প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছে। ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্যকে কালিমালিপ্ত করছে।
সবচেয়ে বড় কথা, এমন কালিমা এ যুগের সংযোজন। তেরো শতকের শুরু থেকে আঠারো শতকের মাঝপর্ব পর্যন্ত শুধু বাংলা নয়, ভারতবর্ষ শাসন করেছে বহিরাগত মুসলমান শক্তি। এ ছয় শতাধিক বছরে এদেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের কোনো অবনতি দেখা যায়নি। তেরো শতক থেকে আরব, ইরান, ইরাক, পশ্চিম এশিয়া-নানা অঞ্চলের সুফি সাধকরা এসে সাড়ম্বরে এ দেশে ইসলাম প্রচার করে সফল হয়েছেন। সেন যুগে ব্রাহ্মণ শাসকদের অত্যাচারে নিপীড়িত শূদ্র হিন্দুরা মুসলিম শাসক ও সাধকদের আনুকূল্য পেয়েছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা গড়ায় সুফিরা ভূমিকা রেখেছিলেন। ইংরেজ শাসন যুগের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এ অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ বজায় ছিল। শেষ দিকে এসে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রতিবাদী ভারতবাসীকে কৌশলে দিকভ্রষ্ট করার জন্য তাদের পরিচিত ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ চালু করে। পরিকল্পিতভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বীজ ঢুকিয়ে দেয়। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে তা আরও স্পষ্ট হয়। পাকিস্তান আন্দোলন ঠেকাতে কোথাও কোথাও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিল। এসবই ছিল সুবিধাবাদীদের আরোপিত। এভাবে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরানো হয় ধর্মীয় কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে।
পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছিল ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’। তবুও সেই যুগে সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্পর্কে বড় রকমের ফাটল ধরেনি। এ পর্বে কয়েকটি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণই সক্রিয় ছিল। আর দাঙ্গাকারী মুসলমানদের বড় অংশ ছিল বিহারি মুসলমান ও সম্পদলোভী কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এখানে খুব কম ছিল। বরঞ্চ সাধারণ মুসলমান দাঙ্গার সময় প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারকে রক্ষার চেষ্টা করেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাম্প্রদায়িক হামলা
- ধর্ম অবমাননা