ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের বিষময় ফল
এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে নড়াইলে দুটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটল। ১৬ জুন জেলার সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে মুসলমানদের 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' দেওয়ার অভিযোগে এক দল পুলিশ ও জনতার সামনে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ন্যক্কারজনকভাবে হাঁটানো হয়।
ওই ঘটনার রেশ না কাটতেই গত ১৫ জুলাই শুক্রবার লোহাগড়ার দিঘলিয়ায় এক হিন্দুপল্লিতে একই ধরনের অভিযোগে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হলো। বাংলাদেশে যে কয়টি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস তুলনামূলক বেশি, সেগুলোর মধ্যে নড়াইলকে ধরা হয় প্রথম সারির একটি জেলা। এক সময়ের প্রগতিশীল রাজনীতির পীঠস্থান এ জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাব তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চেয়ে এতটাই বেশি; ভোটের রাজনীতিতে উদারপন্থিদের প্রথম পছন্দের দলটি গোপালগঞ্জের পরে সম্ভবত নড়াইলকেই নিরাপদ মনে করে। তা ছাড়া গত কয়েক দশকে দেশের বিভিন্ন স্থানে অমুসলিমদের ওপর ডজন ডজন হামলার ঘটনা ঘটলেও নড়াইলে এসবের প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। তেমন একটি এলাকায় একেবারে প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নাকের ডগায় পরপর দুটি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনো মানুষকে বিচলিত করবে, এটাই স্বাভাবিক।
আরেকটি বিষয় খেয়াল করার মতো। তা হলো, জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। আবার মির্জাপুর কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিও একই ধর্মের অনুসারী। প্রাণিজগতে সবার মাঝেই কন্ডিশন রিফ্লেক্স হিসেবে এক ধরনের জাত বা গোত্রপ্রীতি থাকে। মানুষও এর বাইরে নয়। ওই দুটি ঘটনায় দায়িত্বের অংশ হিসেবে না হলেও অন্তত ফেলো ফিলিং থেকেও আক্রান্তদের বাঁচাতে জেলার পুলিশ সুপার ও কলেজ সভাপতির কি কোনো চেষ্টা ছিল? কলেজ সভাপতি অবশ্য বলেছেন, ঘটনার সময় তিনি এলাকায় ছিলেন না। তিনি থাকলে নাকি এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারত না। এটি এক দায়সারা গোছের বক্তব্য; সন্দেহ নেই। তার পরও একটি বেনিফিট অব ডাউট তিনি পেতে পারেন, যেহেতু ঘটনার হোতা স্থানীয় আওয়ামী লীগেরই এক নেতা বলে পরে পরিস্কার হয়েছে এবং কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হলেই যে রাজনৈতিকভাবে তিনি প্রভাবশালী হবেন- এমনটা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু পুলিশ সুপার তো সবই জানতেন। তাঁর অধীনস্তদের সামনেই কলেজ অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরানো হয়েছে। অথচ ঘটনা নিয়ে সমাজমাধ্যমে যখন হৈচৈ শুরু হলো; বলে দিলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না।
শুক্রবারের হামলার ঘটনাও তাৎক্ষণিক কিছু নয়। মহানবী (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর যে ফেসবুক পোস্টের জেরে ওই হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, সেই পোস্টটি কিন্তু শুক্রবার সকালেই হামলাকারীদের নজরে আসে; আর হামলাটা চলে বিকেলে। প্রশ্ন হলো, ওই বিতর্কিত পোস্টের খবর সাধারণ মুসল্লিরা সকালেই জেনে গেছেন, অথচ পুলিশ জানল না! আর হামলার আগে কয়েক ঘণ্টা সময় পেয়েও প্রশাসন তা ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নিল না কেন?