
অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দার বোঝা ব্যাংকের ঘাড়ে চাপবে কি
ঝড়-ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, আর্থিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি, হরতাল-ধর্মঘট ইত্যাদির খবর শুনলেই আমার প্রথম মনে পড়ে ব্যাংকের কথা। কেন? কারণ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি সবকিছুর চূড়ান্ত বোঝা বহন করে শেষ পর্যন্ত বেচারা ব্যাংক ও ব্যাংকাররা। এটা হচ্ছে কারণ ব্যাংকের অর্থায়ন নেই এমন কোনো খাত এখন নেই। এই যেমন দুই-আড়াই বছরের পুরনো কভিড অতিমারী। চীন থেকে আসা এ অতিমারী সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণই শুধু হয়নি, ব্যবসা ও আর্থিক খাতকেও করে দিয়েছে লণ্ডভণ্ড। সামাজিক-রাজনৈতিক জীবন চাকরি-বাকরির ধরনসহ সবকিছুই আজ লণ্ডভণ্ড। আর্থিক খাতে দেখা যায় বাজার অর্থনীতির (মার্কেট ইকোনমি) নিয়মকানুন পরিত্যক্ত।
সুদের হার ওই আগের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক-সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। তাও নির্ধারিত হোটেলে অনুষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের সভায়। বহু আদরে প্রবর্তিত ‘ক্ল্যাসিফিকেশন পলিসি’ (শ্রেণীবিন্যাসকরণ নীতি), ‘প্রভিশন পলিসি’ (সংরক্ষণ নীতিমালা), ‘রিশিডিউলিং অব লোন’ (ঋণের পুনঃতফসিলীকরণ নীতি), সুদে ভর্তুকি নীতি থেকে শুরু করে নানা কেন্দ্রীয় ব্যাংকীয় নীতিমালা আজ আস্তাকুঁড়ে বিসর্জিত। ব্যবসা ও ব্যবসায়ীর যত লোকসান, ক্ষয়ক্ষতির বোঝা আজ সব ব্যাংকের ঘাড়ে। ব্যাংকের ঘাড়ে মানে কী? ব্যাংকের মালিক তো আজ আর সরকার নয়। ৮০ শতাংশই ব্যাংক ব্যবসা বেসরকারি। সরকারি হোক, বেসরকারি হোক আমানতের টাকা সব সাধারণ মানুষের। তাই ব্যাংকের ঘাড়ে বোঝা মানে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে বোঝা, তাদের ক্ষতি, তাদের সুদ কম। এসবই ব্যবসা ও ব্যবসায়ীকে বাঁচানোর জন্য। অথচ ব্যবসার নীতিতেই লাভও ব্যবসায়ীর, ক্ষতিও ব্যবসায়ীর। এ কথা বলেই আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ছেড়ে বাজার অর্থনীতিতে পা দিয়েছিলাম। আজ দেখা যাচ্ছে লাভ ব্যবসায়ীর, ক্ষতি জনসাধারণের। এটা হচ্ছে বেশি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলেই। সাধারণভাবে তো হয়ই, অস্বাভাবিক ঘটনা হলে হয় বেশি করে। যেমন এতক্ষণ বললাম কভিড অতিমারী উদ্ভূত লোকসানের কথা। সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলে হচ্ছে বন্যা। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক—কৃষিঋণ আদায় অনিশ্চিত। ধান-চালের ব্যবসা বিঘ্নিত। ক্ষতি ব্যাংকের, লাভ আড়তদারদের। যেমন পদ্মা সেতু, স্বপ্নের পদ্মা সেতু। কত বড় উপকার হবে এ পদ্মা সেতুর কারণে, তার কোনো হিসাব নেই। পুরো দক্ষিণবঙ্গ, খুলনা-যশোর, এমনকি সীমান্ত ছাড়িয়ে কলকাতা পর্যন্ত সুবিধা বিস্তৃত হবে। এতেও পরোক্ষ ক্ষতি আছে ব্যাংকের। দেখাই যাচ্ছে লঞ্চ-স্টিমারের ব্যবসায় মন্দা নেমেছে ও নামবে। লাভবান হবে সড়কপথের যানবাহন। ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে লঞ্চ-স্টিমার ব্যবসার। এর বোঝা কার ঘাড়ে পড়বে? লঞ্চ-স্টিমারের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে এসবের মালিকরা ব্যাংকের লোনের টাকা কোথা থেকে দেবেন? ব্যক্তি খাত লোকসান হলে ব্যবসায়ীদেরই লোনের টাকা পরিশোধ করতে হতো।
কিন্তু ব্যাংকের টাকা—কে তা পরিশোধ করে? গত নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী তাণ্ডব চলে। বাস পোড়ানো, দোকান পোড়ানো, দিনের পর দিন কর্মবিরতি, রেলগাড়ি পোড়ানো, স্কুল পোড়ানো—কী হয়নি? গাড়ি-ঘোড়া চলেনি, বাস-ট্রাক চলেনি। মানুষের চলাচল বিঘ্নিত। ফলাফল পরিবহন ব্যবসায় ধস। বাস-ট্রাকের ব্যবসা নেই। পর্যটন ব্যবসা, হোটেল-মোটেল ব্যবসায় মন্দা। পর্যটক নেই। এসবের বোঝা কার ঘাড়ে? এসব খাতে যেসব ব্যাংক ঋণ দিয়েছে তাদের টাকার কী হবে? বোঝাই যায় ঋণের পরিণতি কী? এসবের আগে হয়েছে জাহাজের ব্যবসা। মিডিয়া বলতে শুরু করল আমাদের জাহাজ নির্মাণের ব্যবসা হবে খুবই বড় রফতানি খাত। ব্যাংক লাভের আশায় অর্থায়ন করল জাহাজ নির্মাণে। ১০-১৫ বছর আগের অর্থনৈতিক মন্দায় জাহাজ ব্যবসা লাটে উঠল। ব্যাংকের লোনের টাকার কী হবে? আজও তা অনাদায়ী, পুনঃতফসিলকৃত নয় কি? এভাবে বিচার করলে দেখা যাবে ব্যাংক সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য নয়। ব্যাংক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের লোকসানের টাকা পুষিয়ে দেয়ার জন্য। বড়লোককে আরো বড়লোক করার জন্য। ব্যাংক গরিব মানুষ, ছোট উদ্যোক্তা, নারী উদ্যোক্তা, পেশাজীবী উদ্যোক্তা, উত্তরাঞ্চলের উদ্যোক্তা, অনুন্নত অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের জন্য নয়। সরকারি নীতিতেই ব্যাংক ব্যবসায়ীদের স্বল্পমূল্যে ঋণ দেয়ার জন্য। সুদ মওকুফ করা, ঋণ পুনঃতফসিল করা, ঋণ পরিশোধের সময় বর্ধিত করা, সুদে ভর্তুকি দেয়া, নানা ধরনের চার্জ থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার জন্য এখন মনে হয় ব্যাংকের সেবা। এ ধরনের সেবার কোনো শেষ অচিরেই হবে বলে আশা করা যায় না।