মহিমার অবসান : নজরুল ইসলাম ও আধুনিক বাংলা কবিতা
কাজী আবদুল ওদুদ একদাসেই ১৯৪২ সালেলিখিয়াছিলেন, ‘বাংলা দেশে এক শ্রেণীর সাহিত্যরসিক আছেন যাঁরা নজরুল ইসলামকে জ্ঞান করেন একজন যুগ-প্রবর্তক কবি। আজকার দিনে তাঁদের সংখ্যা-শক্তি কেমন জানি না, তবে নজরুল ইসলামের প্রতি তাঁদের কারও কারও অন্তরের গভীর অনুরাগের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। তাঁদের প্রতিপাদ্যের প্রধান অবলম্বন এই “বিদ্রোহী”। তাঁদের ধারণা, এমন একটা ওজস্বিতা নজরুলের এই “বিদ্রোহী” কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যা বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন-বাংলার দার্শনিক আবহাওয়ায় এ চিন্তালেশহীন ভাস্বর-ললাট চির-তারুণ্য, এই দ্বিধাহীন দুর্মদ তারুণ্যই নজরুল-প্রতিভার চিরগৌরবময় দান’ (ওদুদ ১৩৫৮: ৮২)।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবদুল ওদুদ এই দাবি নাকচ করিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার মতে, ‘যাঁদের এই মত, মনে হয় না নজরুলের এই তারুণ্য বাস্তবিকই তাঁরা বুঝতে চেষ্টা করেছেন।’ আবদুল ওদুদের ধারণা, নজরুল ইসলাম কোন নতুন যুগের সূচনা করেন নাই। কারণএক নম্বরে‘রবীন্দ্রনাথের “বলাকা”র যুগে নজরুল প্রতিভার উন্মেষ।’ আবদুল ওদুদ যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা এখনো আমাদের হাসির না হইলেও কৌতূহলের উদ্রেক করে। তাঁহার আরও কিছু কথা উদ্ধার না করিয়া পারিতেছি না এখানে। আবদুল ওদুদের স্মৃতিকথা অনুসারে: “আমরা চলি সমুখ পানে/ কে আমাদের বাঁধবে,/ রইল যারা পিছুর টানে/ কাঁদ্বে তারা কাঁদ্বে” অথবা, “ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,/ ওরে অবুঝ, ওরে সবুজ/ আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা” অথবা, “শিকল দেবীর ঐ যে পূজা-বেদী/ চিরকাল কি রইবে খাড়া,/ পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি’।/ ঝড়ের মাতন বিজয়-কেতন নেড়ে/অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে/ ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে/ভুলগুলো সব আন্ রে বাছা বাছা/ আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা” ইত্যাদি ছত্র সে-যুগের বাংলার শিক্ষিত তরুণ-সমাজে উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিলএক হিসাবে বাংলার তরুণ-আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল এই ‘বলাকা’ কাব্যের সাহায্যে’ (ওদুদ ১৩৫৮: ৮২-৮৩)।