আইন পরিবর্তনে জেলা পরিষদ বৈশিষ্ট্য হারাবে
গত ২৩ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সংসদে 'জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ২০২২' বিল উত্থাপন করেন। বিলটি বর্তমানে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সংসদীয় কমিটিতে রয়েছে। বিলে জেলা পরিষদের মৌলিক ও কাঠামোগত সংশোধনীগুলো হলো- মেয়াদ শেষে সরকার জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে। বিদ্যমান ১৫ সাধারণ সদস্য ও ৫ সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের পরিবর্তে জেলার অন্তর্গত উপজেলার সমানসংখ্যক সদস্য ও এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত সদস্য নিয়ে পরিষদ গঠন হবে। উপজেলা পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান, নির্বাহী কর্মকর্তা ও মেয়র জেলা পরিষদের ভোটাধিকারহীন সদস্য হবেন। এই মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। জেলা পরিষদের আছে স্বতন্ত্র সত্তা ও ধারাবাহিকতা। প্রশাসক নিয়োগে গণতন্ত্র সংকুচিত হয়ে আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হবে। এর রয়েছে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রভাব। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচিতরা বদলে অনির্বাচিত ব্যক্তি থাকলে জাতীয় নির্বাচনকালে দেশ পরিচালনায় অনির্বাচিত সরকারের দাবির যুক্তি জোরালো করবে।
বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় প্রাদেশিক সরকার বা আইনসভা অর্থাৎ এ জাতীয় ক্ষমতা ভাগাভাগির বিষয় নেই। তাই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ, প্রশাসন, রাজস্ব ও উন্নয়ন কার্যক্রম একক সরকারের ওপর নির্ভরশীল। আবার শক্তিশালী স্থানীয় সরকার না থাকয় ছোটখাটো কোনো কাজের জন্যও মানুষকে ঢাকায় ছুটতে হয়। দেশে যদিও আটটি বিভাগ রয়েছে, তবে তা কোনো স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত স্তর নয় বরং জেলাগুলোর কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে তদারকি স্তর। স্থানীয় পর্যায়ে ছোটখাটো বিষয়ের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্থানীয় শাসন কর্তৃপক্ষকে প্রদানের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করতে অর্থাৎ জনগণকে শাসন ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করতে স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে বিদ্যমান তিন স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার রয়েছে। এর মধ্যে জেলা হলো সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। একমাত্র জেলাকে সংবিধানে সরাসরি প্রশাসনিক একাংশ অর্থাৎ স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যগুলোকেও আইনের দ্বারা প্রশাসনিক একাংশ ঘোষণার সুযোগ সংবিধানে রাখা হয়েছে।
জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০০৬ সালের ৬ জুলাই জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন করা হলেও জেলা পরিষদে নির্বাচন হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। এর আগে জেলা পরিষদ নামে ভবন, বরাদ্দ ও বাজেট থাকলেও বাস্তবে কোনো পরিষদ ছিল না। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জেলা পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। আইনটি প্রণয়নের আগেও সবকিছু ছিল; ছিল না শুধু পরিষদ। কার্যক্রম পরিচালনা করতেন জেলা পরিষদ সচিব পদে নিয়োজিত সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। তখন কার্যকর ছিল স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন ১৯৮৮, যার অধীনে এরশাদ সরকারের আমলে একবার গঠিত হয়েছিল জেলা পরিষদ। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে এই পরিষদগুলো বাতিল করে। ওই সময়ের পরিষদ এবং তৎপূর্বে জিয়াউর রহমানের আমলে বিদ্যমান জেলা পরিষদের ছিল না সাংবিধানিক স্বীকৃতি। এর কারণ ১৯৭৫ সালে বাকশাল ব্যবস্থা প্রচলনের লক্ষ্যে জেলাগুলোয় অনির্বাচিত গভর্নর নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তাই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রণয়নের সময় অনেক বিধানের পরিবর্তন ও বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ এবং ১৫২ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রশাসনিক একাংশ সংজ্ঞা বিলুপ্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে অনুচ্ছেদ দুটি ও ১৫২ অনুচ্ছেদে সংজ্ঞা দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনঃস্থাপিত হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিল সংসদে
- জেলা পরিষদ আইন