পারিবারিক আইন সংস্কারে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু
ধর্মীয় পারিবারিক আইনে ইতিবাচক সংস্কার আনার সঙ্গে সংখ্যার গুরু-লঘুর ভেদবুদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। অন্ততপক্ষে, ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এমন একটা কথা বলে দেওয়া যেতেই পারে। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ ভেঙে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার ৯ বছরের মধ্যেই জনসংখ্যার বিচারে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত রাষ্ট্র হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫; হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ১৯৫৬; হিন্দু নাবালকত্ব ও অভিভাবকত্ব আইন, ১৯৫৬ এবং হিন্দু ভরণপোষণ আইন, ১৯৫৬এই চারটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সে দেশের হিন্দু পারিবারিক আইনে যুগান্তকারী সংস্কার আনতে সক্ষম হয়। অথচ পরাধীনতার সুদীর্ঘকালের মধ্যে জনগণের মধ্য থেকে ব্যাপক সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও সেসব বিষয়ে আইন করা সম্ভবপর হয়নি। ব্রিটিশ-ভারত ভাগ হয়ে সৃষ্ট অপর দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানও ভারতের পাঁচ বছর পরই ১৯৬১ সালের মধ্যেই মুসলিম পারিবারিক আইনের সংস্কার আনতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনামলে মুসলিম পারিবারিক আইনের যেসব ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো প্রকট হয়েই ছিল, তার মধ্যে নারীদের উত্তরাধিকার ও সন্তান দত্তক নেওয়ার ব্যাপার দু’টি ছাড়া বাকি সমস্যাগুলোতে কমবেশি সংস্কার আনতে সক্ষম হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ভারত, পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার পর বাংলাদেশও নিজ নিজ দেশের ধর্মীয় বিচারে সংখ্যাগুরুদের পারিবারিক আইনে আরও সংস্কার এনে আরও উন্নতি করেছে। একদা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে কালক্রমে স্বাধীন হওয়া তিন রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয় বিবেচনায় সংখ্যাগুরুদের পারিবারিক আইনে এমন সংস্কার সম্পন্ন হলেও তিন রাষ্ট্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পারিবারিক আইনের দিকে তাকালে কিন্তু একেবারেই ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়।
১৯৪৭ এর পর থেকে পাকিস্তানি আমলের ২৪ বছরের পর ১৯৭১ এর স্বাধীনতার পর থেকে আজ ২০২২ সাল পর্যন্ত হিন্দু পারিবারিক আইনে য একমাত্র সংস্কারটি বাংলাদেশে আনা সম্ভব হয়েছে, সেটি হচ্ছে হিন্দু বিবাহের নিবন্ধন করার বিধান; তাও আবার ঐচ্ছিক! বাকি সব ক্ষেত্রে ১৯৪৭ পূর্ববর্তী তিমিরেই রয়ে গেছে হিন্দু পারিবারিক আইন। বাংলাদেশে হিন্দু নর-নারীর বিবাহবিচ্ছেদের আইনি বিধান নেই, সম্পত্তিতে আইনি উত্তরাধিকার নেই, আজও! বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রগতিশীলতা দেখিয়েছে পাকিস্তান! তাদের সিন্ধু প্রদেশে ২০১৬ সালে এবং জাতীয় স্তরে ২০১৭ সালে পাস হয়ে গেছে হিন্দুদের বিবাহ, বিচ্ছেদ ও নিবন্ধন সম্পর্কিত আইন! আর সবচেয়ে হতাশ করেছে তারা যাদের সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকার কথা সেই ভারতের! স্বাধীনতার ৭০ বছর পর ২০১৭ সালে সর্বপ্রথম ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে তিন তালাককে অসাংবিধানিক ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার আরও এক কাঠি এগিয়ে ২০১৯ সালে তিন তালাককে অপরাধ বলে আইন পাস করে। অবশ্য এর আগে ১৯৮৫ সালে শাহবানু মামলায় তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর ভরণপোষণ নিয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট একটা রায় দিলেও তা পার্লামেন্টে আইন পাসের মাধ্যমে রদ করা হয়। ২০০১ সালে দানিয়েল লতিফি মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে শাহবানু মামলার রায়ের বাস্তব অংশগুলো অবশ্য পুনরুদ্ধার করা হয়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয়টি হলো নাগরিকদেরই আদালতে লড়াই করতে হচ্ছে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। রাষ্ট্র স্বয়ং সংখ্যালঘুদের জন্য আইন করতে এগিয়ে আসছে না, বরং আইন করে আদালতের প্রাগ্রসর রায় নস্যাৎ করছে। আর যখন একটা আইন করছে তাতে বিদ্বেষের ছাপ স্পষ্ট!