করপোরেট মিডিয়ার চেয়েও সোশ্যাল মিডিয়া বেশি করপোরেট
সম্প্রতি ভারতীয় লেখক ও অধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউজ শো 'ডেমোক্রেসি নাউ'। টেলিভিশন, রেডিও ও ইন্টারনেটে বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারিত এই সংবাদ-অনুষ্ঠানের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে অনলাইনে তার মুখোমুখি হন এমি গুডম্যান ও নারমিন শাইখ। ডেমোক্রেসি নাউ ওয়েবসাইট থেকে এর সংক্ষেপিত ভাষ্য ভাষান্তর করেছেন শেখ রোকন।
ডেমোক্রেসি নাউ: আপনি যখন বলেন যে, সংবাদমাধ্যম, বিশেষত স্বাধীন সংবাদমাধ্যম নানাভাবে, এমনকি ধারণাগত দিক থেকেও হুমকির মুখে, তখন আসলে কী বোঝাতে চান?
অরুন্ধতী রায়: বেশ, আমি বোঝাতে চাই যে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম তথা মিডিয়া সবসময়ই স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে আসছে। কিন্তু এখন এক অর্থে আমাদের এমন মিডিয়া দরকার, যা স্বাধীন মিডিয়ার প্রভাব থেকেও স্বাধীন হবে। সংবাদ ও ভুয়া সংবাদ কীভাবে গুলিয়ে দিয়ে গোটা বিশ্বেই সরবরাহ করা হচ্ছে, আপনাদের সেই ধারণা আছে। কীভাবে সামাজিক মাধ্যম মানুষকে ইকো চেম্বারে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, সেখান থেকে তারা আর বের হতে পারছে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এসবের ডামাডোল পেরিয়ে আপনার কণ্ঠস্বর যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পারবেন না। আমরা যারা কিছু করতে চাই, এর মধ্য দিয়েই করতে হচ্ছে। একদিকে দৈত্যকায় করপোরেট মিডিয়া, অন্যদিকে এক বাটখারায় সব মাপা সোশ্যাল মিডিয়া। এর অ্যালগোরিদম এখন বড় সমস্যা তৈরি করছে। এটা এত বেশি তথ্য প্রবাহ তৈরি করছে যে, যা মানব মস্তিস্কের পক্ষে প্রক্রিয়াজাত করা কঠিন। ফলে এই ঝড়ের মধ্য দিয়ে আমাদের ছোট নৌকা কীভাবে পাড়ি দেবে?
ডেমোক্রেসি নাউ: আগে এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, বিকল্প মিডিয়ার এমন কিছু করতে হবে, যাতে করে এমন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে যেখানে করপোরেট মিডিয়া অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এখন আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালো-মন্দ গুলিয়ে ফেলার বিরূপ প্রভাবের কথা বলছেন। বলছেন এটা আরও বেশি ক্ষতিকর, কারণ বিশ্বজুড়ে এর ভোক্তা আরও বেশি মানুষ। ফলে যখন হুমকি প্রায় দুই দিক থেকে আসছে, তখন স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অরুন্ধতী রায়: ঠিকই বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়া একটি স্বাধীন মিডিয়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং বলে থাকে যে, এই মাধ্যম তাদের কণ্ঠস্বর বর্ধিত করে ও ছড়িয়ে দেয়, যাদের কণ্ঠ শোনা যেত না। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা গতানুগতিক করপোরেট মিডিয়ার চেয়েও বেশি করপোরেট। ফলে আমরা এখন এমন এক পরিস্থিতিতে, যেটাকে তুলনা করা যেতে পারে শাঁখের করাতের সঙ্গে।
ভারতের কথাই ধরুন। মূলধারার মিডিয়া, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, শত শত ২৪ ঘণ্টা নিউজ চ্যানেল- সবই পরিচালিত হয় মূলত করপোরেট অর্থায়নে। এখন ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের স্ক্যান্ডালও প্রকাশ পাচ্ছে। তারা কীভাবে বিজেপি ও ডানপন্থিদের সমর্থনে পক্ষপাতমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, এগুলো বের হয়ে আসছে। এখানে পরিস্থিতি হচ্ছে বিষাক্ত তরলের মধ্য দিয়ে সাঁতার কাটার মতো, বিষের মধ্যে খাবি খাওয়ার মতো। আপনি এখন সামান্য কয়েকটি মিডিয়া পাবেন, বেশিরভাগই অনলাইন এবং এক বা দুটি প্রিন্ট ম্যাগাজিন, যেগুলো থেকে আপনি জানতে পারবেন আসলেই কী ঘটছে। তাদের সবাই সাহসিকতার সঙ্গে টিকে থাকার চেষ্টা করছে এবং চারদিক থেকে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। আমেরিকাতেও আপনাদের ডেমোক্রেসি নাও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি, আমি জানি।
এখন এমন একটা সময় যখন মিথ্যা খবর এতটা বেশি মাত্রায় প্রকাশ হচ্ছে এবং তাতে বিষের মাত্রা এতটা বেশি যে, ভারতের মতো একটি দেশের মেরুদণ্ডে চিড় ধরাচ্ছে। এমনকি ধারণাগত দিক থেকেও আমরা জানি না যে, কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। এখন আবার শুরু হয়েছে এক ভাষা, এক জাতি, এক ধর্ম। এই বিষয়টি দেশটাকে ছিঁড়ে ফেলতে যাচ্ছে। অথচ এ দেশের সামাজিক বুনট অনেক শতাব্দী ধরে বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্মের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারতাবাদ- যে নামেই ডাকুন না কেন, এটাই এ দেশের সামাজিক চুক্তি সম্ভব করে তুলেছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে আপনি যদি এই সামাজিক বুনটকে অগ্রাহ্য করতে যান, তাহলে এটা ভেঙে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নে তাই ঘটেছিল, যুগোস্লাভিয়ায় তাই ঘটেছিল। পরিস্থিতি এমন দিকে যাচ্ছে, সামান্য চিড় থেকেই ভেঙে পড়তে পারে। এমনকি ফেসবুক বা ওই ধরনের অন্য কোম্পানিগুলো যারা চালায়, তারাও এই সত্য জানে। তারা জানে যে, তারা আমাদের এমন একটি ঘূর্ণিঝড়ের দিকে ধাবিত করছে, যেখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সোশ্যাল মিডিয়া
- সমালোচনা
- কর্পোরেট খাত