শিক্ষায় ৩ সংকট!

সারাক্ষণ জাকারিয়া স্বপন প্রকাশিত: ৩১ জানুয়ারি ২০২১, ১২:০৭

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কুইজ’ পরিচালনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমাদের কাছে এখন ১০ লাখের বেশি ছাত্রছাত্রীর তথ্য আছে এবং লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ হয়েছে। করোনার এই সময়ে তাদের লেখাপড়ার যেমন সংকট আছে, আবার করোনা-পরবর্তী সময়ে স্কুল-কলেজ খুলে দিলেই যে সেই সংকটগুলো কেটে যাবে, তা কিন্তু নয়। সংকটগুলো বেশ গভীর এবং সবাই হয়তো সেগুলো জানেন।

আমার অভিজ্ঞতার আলোকে সেই সংকটগুলোকে এখানে লিখে রাখার চেষ্টা করি। হয়তো এগুলো নিয়ে কাজ হবে, কেউ কেউ এগুলো সমাধানও করে ফেলবেন। তাই ভাবনাগুলোকে লিখে রাখাটা জরুরি মনে করছি।

১. ইন্টারনেট সংযোগ

আমরা প্রতি সপ্তাহে ফেসবুক এবং ইউটিউবে লাইভ অনুষ্ঠান করে কুইজের বিজয়ীদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। সেই লাইভে গড়ে ৩০ হাজারের বেশি কমেন্টস থাকে। অর্থাৎ এই মানুষগুলো ওই সময়ে লাইভ অনুষ্ঠানটি দেখেছে। কিন্তু যখনই আমরা কোনো প্রতিযোগীকে লাইভে আনতে চাই, তখনি বাধে বিপত্তি।

কিছু উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বঙ্গবন্ধু কুইজে তারা অংশ নিচ্ছে। এমন আমাদের অসংখ্যবার হয়েছে যে, লাইভে অংশ নিতে কিংবা লাইভটি দেখার জন্য একজন ব্যবহারকারীকে ১০ মাইল দূরে বাজারে গিয়ে সিগন্যাল পেতে হয়েছে। অসংখ্য মানুষ আমাদের বলেছেন, ঘরের ভেতর তাদের সিগন্যাল নেই। আর যারা লাইভে আসতে পেরেছেন, সবাই তাদের দেখেছেন যে তাদের সংযোগ স্থিতিশীল নয়। একটু পরপর তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এটা কিন্তু এমন নয় যে কিছু কিছু মানুষের এমন হয়েছে। বেশিভাগেরই এই অবস্থা। এটা মোটামুটি বলে দেয়া যায় যে, ঢাকার বাইরে ইন্টারনেটের অবস্থা খুবই খারাপ। ঢাকায় সংযোগ ভালো। কিন্তু যেই বিশালসংখ্যক মানুষ এই ঢাকা শহরের বাইরে থাকেন, তাদের সংযোগ মোটেই ভালো নয়। এটা নিয়ে কেউ তর্ক করতে এলে বুঝতে হবে, সে আসল বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে তর্কের খাতিরে তর্ক করতে এসেছে। তাদের সঙ্গে তর্কে না যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বাস্তবতা হলো এই যে, সংযোগ ভালো নয়।

এদের বেশিভাগই ইন্টারনেট সংযোগ পেয়ে থাকে মোবাইল ডেটা দিয়ে। ওয়াই-ফাই কিংবা ফিক্সড ব্রডব্যান্ড তাদের ওখানে এখনো যায়নি। কিন্তু আমাদের দেশে তো সারা দিন দেখতে পাচ্ছি মোবাইল অপারেটররা বলছে দেশে তারা থ্রি-জি এবং বেশিভাগ এলাকা ফোর-জি কভারেজ দিয়ে ফেলেছে। এই কথা তো সত্যি নয়। অন্তত পারফরম্যান্স তো তা বলে না। ২০২১ সালে এসে যদি থ্রি-জি কিংবা ফোর-জি নিয়ে এই ছোট ভূখণ্ডের মানুষকে ভুগতে হয়, তাহলে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চলবে কীভাবে?

এই নেটওয়ার্ক দিয়ে আর যাই হোক ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া যে হবে না, সেটা নিশ্চিত। কোভিডের পর যদি আমরা স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে পুরোটাই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই, তাহলে আমরা তো আর সামনে এগোলাম না। আমাদের দুটোই রাখতে হবে। ক্লাসে যেমন শিক্ষা নেবে, অনলাইনেও শিক্ষা নেবে। সে কারণে ইন্টারনেটের মান নিশ্চিত করাটা জরুরি। এই ইন্টারনেট নিয়ে বহু কথা হয়েছে। খুব একটা লাভ হয়নি। এখনো কথা বলতেই হচ্ছে।

২. ডিভাইস

কুইজের পুরস্কার হিসেবে আমরা ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এবং মোবাইল ডেটা দিচ্ছি। এবং বাচ্চারা এই ডিভাইসগুলোর জন্য মরিয়া হয়ে গেছে। তারা যারপরনাই চেষ্টা করছে, কীভাবে এখান থেকে ডিভাইস পাওয়া যেতে পারে। তাদের আকুতিগুলো যদি কেউ ফেসবুকে পড়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে পারবেন কী সাংঘাতিক মনোবেদনা নিয়ে তারা জীবনযাপন করছে।

আমি ধরে নিচ্ছি, অনেকেই হয়তো একটি ফ্রি ডিভাইসের জন্য আকুতি করছে। হয়তো অনেকের তার এই চাওয়াটা সঠিক নয়। কিন্তু এটাও সত্যি যে, লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর কাছে সঠিক ডিভাইস নেই। তার কাজ চালানোর মতো স্মার্টফোন, কিংবা ট্যাব নেই। ল্যাপটপ তো অনেক দূরে।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। সে চাইলেই তার সব ছাত্রছাত্রীকে ডিজিটাল ডিভাইস দিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু এই ডিজিটাল ডিভাইস ইতোমধ্যেই একটি বিশাল ডিজিটাল ডিভাইড তৈরি করে ফেলেছে। বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশই হলো মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের বড় একটা অংশকে সরকারি বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই দেশে এইচএসসি পরীক্ষার্থীই আছে ১০ লাখের ওপর। সব মিলিয়ে ৪ কোটির ওপর শিক্ষার্থী। এদের বড় একটি অংশের কাছে ডিভাইস নেই।

যাদের কাছে ডিভাইস নেই, সেই ছাত্রছাত্রীটির কি মেধা নেই? সে কি এই সমাজে কন্ট্রিবিউট করতে পারার যোগ্যতা রাখে না? তার কি নিজেকে তৈরি করার যোগ্যতা নেই? তার হয়তো সবই আছে- কিন্তু ডিভাইস নেই। ফলে তার জন্য সামনে এগোনো খুব মুশকিল হয়ে যাবে। আমরা কম্পিউটার পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে গিয়ে। কিন্তু এখন তো সচ্ছল পরিবারের বাচ্চারা ডিভাইস পেয়ে যাচ্ছে কিন্ডারগার্টেন থেকে। তাহলে এই ছোট বাচ্চাটি যা শিখবে, তার সঙ্গে ডিভাইসহীন বাচ্চাটির পার্থক্য হবে বিশাল। এই দূরত্ব সে সারা জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারবে না।

এই বিশালসংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে কীভাবে ডিভাইস দেয়া যাবে, সেটা এখন সবারই চিন্তার বিষয় হয়েছে নিশ্চয়। কারণ, বিষয়টি এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। এর একটি উপায় বের করতে হবে বৈকি! নয়তো আমরা তরুণ জাতি হিসেবে যেই সুবিধাটুকু পাচ্ছি, তা তো আর বেশি দিন পাওয়া যাবে না। তখন সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

৩. কনটেন্ট

ইন্টারনেট সংযোগ এবং ডিভাইসের সংকট কাটিয়ে উঠলেও পরের বড় সংকট হলো কনটেন্ট- ডিজিটাল কনটেন্ট।

বাংলাদেশের যে শিক্ষাব্যবস্থা, তাতে বেশিভাগ ছাত্রছাত্রীর প্রাইভেট টিউটর প্রয়োজন হয়। গ্রামগঞ্জ ও শহরে- যেখানেই পরিবারগুলো একটু কুলিয়ে উঠতে পারে, তারা প্রথমেই বাচ্চার জন্য প্রাইভেট টিউটর রেখে দেয়। সেটা টিউটরের বাড়িতে গিয়ে পড়ুক, আর নিজের বাড়িতেই হোক। প্রাইভেট শিক্ষক তার লাগেই।

এটা আমাদের সময় যেমন ছিল, এখন আরও বেড়েছে। বেশিভাগ বিষয়েই ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য লাগে, স্কুল কিংবা কলেজের ক্লাস রুমের পড়ায় তাদের যথেষ্ট হয় না।

এই যে বিশালসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর বাড়তি সাহায্য লাগে, সেটা ডিজিটাল পদ্ধতিতে কীভাবে দেয়া হবে? সেই শিক্ষকরা তো ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করতে জানেন না। এবং রাতারাতি অসংখ্য মানুষ ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করে ফেলে দেশের এই সংকট কাটিয়ে দেবেন- বিষয়টি কিন্তু এমনও নয়। বিষয়টি ইন্টারনেটে লাইভ ক্লাস নেয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমান সময়ে আরও অসংখ্য বিষয়ে তাকে অনলাইনে শিক্ষা নিতে হচ্ছে। বিষয়বস্তুটি বুঝতে পারা, এসাইনমেন্ট দেয়া, পরীক্ষা নেয়া- ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিটিই বিশাল একেকটি ক্ষেত্র। বিগত শত বছর ধরে যেভাবে ছাত্রছাত্রীরা শিখত, সেই পদ্ধতি তো এখন ভেঙে গেছে। তাহলে কীভাবে তাদের শেখানো যাবে? এবং সংখ্যাটি যখন ৪ কোটির বেশি, তখন?

তবে ডিজিটাল পদ্ধতির একটি বড় সুবিধা হলো স্ক্যালিং করা। অর্থাৎ একজন শিক্ষক হয়তো সরাসরি ১০ জন ছাত্রছাত্রীকে একত্রে বাসায় পড়াতে পারেন, নয়তো ৪০-৫০ জন একটি ক্লাসে। সঠিকভাবে কনটেন্ট তৈরি করতে পারলে, একটি ভালো ক্লাস বা কনটেন্ট সারা দেশের ছাত্রছাত্রীরা সেটা থেকে উপকৃত হতে পারে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন খুবই পরিকল্পিত প্ল্যাটফর্ম। সেই ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম এবং কনটেন্ট যদি না থাকে, তাহলে ইন্টারনেট এবং ডিভাইস দিয়ে অর্ধেক সমস্যার সমাধান হবে। বাকি অর্ধেক তো এখানে আটকে গেল!

তাই কোভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং সমাধানের জায়গা হবে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঠিক করা। এবং আগামী কয়েক বছর বিনিয়োগও করতে হবে শিক্ষায়। আমাদের অনেকগুলো মেগা প্রকল্প চলছে। এর পরের মেগা প্রকল্প হওয়া উচিত শিক্ষা, শিক্ষা এবং শিক্ষা।

তাহলেই হয়তো আমাদের ছেলেমেয়েগুলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অন্তত যোগাযোগ রেখে জীবন চালাতে পারবে। পাশাপাশি নিজের দেশে কন্ট্রিবিউট করতে পারবে।

ইমেইল: [email protected]

ঢাকা, ২৯ জানুয়ারি ২০২১

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও