সংবাদপত্রগুলো আদৌ কি বাঁচবে?
অস্ট্রেলিয়ার সরকার একটি নতুন আইন করতে যাচ্ছে, যেখানে বলা হয়েছে গুগল, ফেসবুক কিংবা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান যখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম দেখাবে, এবং লিংক করবে, তখন গুগল বা ফেসবুক সেই প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিতে হবে।
বিষয়টি যদি আরও খুলে বলি, আমরা যখন কিছু সার্চ করতে যাই তখন গুগল অসংখ্য অপশন দেখায়। পাশাপাশি তারা নিউজ এগ্রিগেট করে। পুরো দুনিয়ার যাবতীয় সংবাদ তারা এক জায়গায় নিয়ে আসে। এবং বিভিন্ন রকমের এলগরিদমের মাধ্যমে সেগুলো মানুষকে দেখিয়ে থাকে।
গুগলের মূল বিজনেস মডেলই এটি। তার মূল কাজই হলো রোবটের মাধ্যমে সারা দুনিয়ার ওয়েবসাইটগুলোকে ক্রল করা, এবং সেগুলোকে গুছিয়ে রাখা যেন গ্রাহক যা খুঁজছে তা মুহূর্তেই দেখানো যায়। একইভাবে সংবাদগুলোকেও তারা সংগ্রহ করে। এবং আপনার পছন্দমতো সংবাদ আপনার সামনে তুলে ধরে। আপনি ক্লিক করে সেই সাইটে গিয়ে সংবাদটি পড়তে পারেন।
কাছাকাছি একই কাজ করে ফেসবুক। একটু ভিন্নভাবে। সেখানে আমরাই সংবাদ নিজেরা গিয়ে দিয়ে আসি, যেন অন্যরা সেই সংবাদটি পড়তে পারে। পাশাপাশি এখন তো আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ফেসবুকে টাকা দিয়ে সেই সংবাদ বুস্ট করছি, যেন আরও বেশি মানুষ সেগুলো পড়তে পারে।
এগুলো একদম ফান্ডামেন্টাল। ডিজিটাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরিই হয়েছে এই কাজ করার জন্য। কিন্তু ঝামেলা বাধিয়েছে বাণিজ্য। অস্ট্রেলিয়া সরকার দেখেছে, তাদের বিজ্ঞাপনের শতকরা ৮০ ভাগ চলে যাচ্ছে গুগল এবং ফেসবুকের কাছে। সেখান থেকে তারা কিছুই পাচ্ছে না। পাশাপাশি, তাদের সংবাদমাধ্যমগুলো অর্থসংকটে পড়ে বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। তারা নিজেরা তো বিজ্ঞাপন পাচ্ছেই না, উপরন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ভর্তুকি দিয়ে মিডিয়া চালাতে হচ্ছে। অনেক মিডিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এবং আরও অনেকগুলো বন্ধ হওয়ার পথে।
অস্ট্রেলিয়ার মতো ফ্রান্সও একই চিন্তা করতে শুরু করেছে। তারাও গুগলের সঙ্গে দেনদরবার করতে শুরু করেছে, কীভাবে স্থানীয় মিডিয়াগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তারাও গুগলের আয় থেকে ভাগ চাইছে। বলছে, স্থানীয় মিডিয়াগুলোকে তাদের লিংক দেখানোর জন্য টাকা দিতে হবে।
এদিকে গুগল উল্টো হুমকি দিচ্ছে যে, যদি অস্ট্রেলিয়া এই আইনটি পাস করে, তাহলে তারা অস্ট্রেলিয়াতে সার্চ সেবা বন্ধ করে দেবে। এবং গত সপ্তাহে তারা কিছু সার্চ বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক গ্রাহক গুগলে গিয়ে সার্চ করে ওই নিউজসাইটগুলোকে পায়নি। এবং সংবাদ পড়তে পারেনি। গুগল স্বীকার করেছে যে, পরীক্ষামূলকভাবে এটা করা হয়েছিল।
কী এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে পুরো বিশ্বকে।
২.
মিডিয়া নিয়ে যারা লেখাপড়া করেন, কিংবা খোঁজ রাখেন, তারা নিশ্চই জানেন যে, পুরো পৃথিবীতেই ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে সংবাদপত্রগুলোর ওপর। ছাপার পত্রিকা তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছেই, পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যে কীভাবে টিকে থাকবে, সেই চিন্তাই তাদের গ্রাস করেছে।
উন্নত বিশ্বের অনেক মিডিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এবং ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। তারা আর পেরে উঠছে না। কর্মীদের বেতন দেয়া অনিশ্চয়তার ভেতর পড়েছে। ডিজিটাল মিডিয়া থেকে যেটুকু উপার্জন হয়, তা দিয়ে মোটেও সংকুলান হয় না। এখন তাদের ওয়েবসাইটে গেলে দানের জন্য বিশাল করে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। এবং তারা শিরোনামই করছে এভাবে যে, সংবাদ এখন ঝুঁকির মুখে!
তবে ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েবের জনক টিম বার্নার্স-লি (১৯৮৯ সালে তিনি এটা আবিষ্কার করেন) বলছেন, যদি সত্যি সত্যি অস্ট্রেলিয়া এই আইনটি পাস করে, তাহলে পুরো ইন্টারনেট ভেঙে পড়বে। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ওয়েবসাইটের মূল কথাই হলো একে অন্যের সাইট লিংক করবে। এমনকি সংবাদমাধ্যমগুলোও অন্য সাইটের লিংক বসিয়ে থাকে। পুরো ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব দাঁড়িয়েই আছে একে অপরের লিংক শেয়ার করে। এখন যদি সবাইকেই এর জন্য টাকা দিতে হয়, তাহলে পুরো সিস্টেমটাই ভেঙে পড়বে।
আর অস্ট্রেলিয়া যদি এই আইন পাস করে, তাহলে অন্য দেশগুলোও সেটা করতে শুরু করবে। তখন সবাই একেকটি দ্বীপে পরিণত হবে। এবং কেউ কারো লিংকে ক্লিক করে অন্য সাইটে বা নিউজে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে পুরো ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব মৃত্যুর মুখে পড়বে।
৩০ বছর ধরে এভাবেই কনটেন্ট লিংক করার পদ্ধতি চলে আসছে। এবং এই কারণেই ইন্টারনেট এত জনপ্রিয়। একজন ব্যবহারকারী একটি ওয়েবসাইট থেকে সহজেই আরেকটি ওয়েবসাইটে চলে যেতে পারছে। এবং এই যে জাল সারা পৃথিবীতে তৈরি করা হয়েছে, সেটা ভেঙে দিলে তো আর বর্তমান ইন্টারনেট থাকবে না। তখন প্রতিটি ওয়েবসাইট শুধু তার নিজের লিংক বসাতে পারবে। অন্য কারো লিংক বসাতে গেলেই কপিরাইটের মামলা খেতে হবে।
গুগল এবং ফেসবুক উভয়েই বলছে, তাদের পক্ষে প্রতিটি পাবলিশার্সের সঙ্গে এভাবে চুক্তি করা সম্ভব নয়। এই যুদ্ধ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাই দেখছে পুরো বিশ্ব।
৩.
ডিজিটাল মিডিয়ার এই ধাক্কা কিন্তু বাংলাদেশেও লেগেছে ইতোমধ্যেই। করোনাকালে সেটা আরও বেগবান হয়েছে। পত্রিকাগুলোর সার্কুলেশন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এবং তারা সবাই এখন নিজেদের ওয়েবসাইট বাদ দিয়ে ফেসবুক এবং ইউটিউবনির্ভর হয়ে উঠছে। তারা ফেসবুকে লাইভ করছে, ইউটিউবে ভিডিও দিচ্ছে, এমনকি টিভিগুলো বেশি দর্শক পাচ্ছে অনলাইন থেকে। কী সাংঘাতিক কথা।
আমার সত্যি মায়া লাগে, যখন দেখি দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলো ফেসবুকে এসে লাইভ করছে বাড়তি উপার্জনের আশায়। এতে করে পত্রিকার পাঠক কিন্তু বাড়ছে না। তারা নতুন গ্রাহক তৈরি করছে ফেসবুক এবং ইউটিউবে। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। ওখানে দর্শকরা সংবাদমাধ্যমের ভিডিও দেখার চেয়ে অনেকের নিজস্ব চ্যানেল অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং তারাই এখন সেলিব্রেটি।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও একই বিষয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, এবং আরও হবে। ছাপার কাগজ খুব অল্প থাকবে। দৈনিক পত্রিকাগুলো বন্ধ হবে দুটো কারণে। তারা যেহেতু ভালো বেতন দিতে পারবে না, তাই ভালো কর্মীরা ওখানে যাবে না। পত্রিকাগুলোর মান, রিপোর্টিংয়ের মান ভয়াবহভাবে নিম্নগামী হবে। সেটা আমরা দেখতে শুরু করেছি। আর যেহেতু মান কমে যাবে, তখন মানুষ আরও মুখ ফিরিয়ে নেবে। দৈনিক আপডেট মানুষ অনেকগুলো মাধ্যমে পেয়ে যাবে। ছাপার পত্রিকা পড়ে তাকে জানতে হবে না। যাদের ছাপার ভার্সন লাগবে, তারা ওয়েব থেকে প্রিন্ট করে নেবে। ছাপার পত্রিকার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না- এটাই মেনে নিতে হবে।
এবারে আসি ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম নিয়ে। মানুষ যে হারে ব্যস্ত হয়ে উঠছে, তাতে তার হাতে দিনের ২৪ ঘণ্টাই আলাদা করে সংবাদ পড়ার সময় খুব একটা থাকবে না। তবে সে আশপাশের সংবাদ পেয়ে যাবে ঠিকই। সেটা একজন প্রফেশনাল সাংবাদিকের কাছ থেকে পাবে, নাকি কারো স্ট্যাটাস থেকে পাবে- সেটাই হলো কথা। পরেরটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শুধু জাতীয় কিছু ইস্যুতে হয়তো মানুষ দু-একটি মাধ্যমকে বেছে নেবে।
শেষে তাকানো যাক বাণিজ্যের দিকে। গুগল কিংবা ফেসবুকের সঙ্গে দেনদরবার মতো ক্ষমতা আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। এবং সেই সক্ষমতা তৈরি হতে আরও অন্তত ১০ বছর সময় লাগবে। আরও বেশিও লাগতে পারে। তাই আমাদের মিডিয়াগুলো ফেসবুক কিংবা গুগল থেকে টাকা পাবে- সেটা অনেক দূর। আমাদের মিডিয়াগুলোকে ফেসবুক বা ইউটিউবে লাইভ করে যা আয় করে, তার ওপরই নির্ভর করে থাকতে হবে। পাশাপাশি আমাদের স্থানীয় মিডিয়াগুলোকে প্রটেকশন দেয়ার জন্য কোনো নিয়মনীতি নেই। বিজ্ঞাপনদাতারা এখন সরাসরি গুগল এবং ফেসবুকেই বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। স্থানীয় মিডিয়াগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদেরও যে বিজ্ঞাপন লাগবে, সেটা দেখার কেউ নেই।
ফলে মোটামুটি বলা যায়, বাংলাদেশে মিডিয়া একটি একমুখী প্রচারযন্ত্রে পরিণত হবে। ধনী কোনো মানুষ তার নিজের কাজের জন্য মিডিয়াকে তৈরি করবেন, ব্যবহার করবেন। গণমানুষের জন্য মিডিয়ার কোনো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আপতভাবে নেই। গণমানুষের জন্য মিডিয়া তৈরি করতে হলে একটি স্বচ্ছ নীতিমালা লাগবে, এবং গণমানুষের অংশগ্রহণ লাগবে। এখন মানুষের কথা বলার জায়গা হয়েছে ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রাম, নয়তো ইউটিউব। সেই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এসে পাঠককে নিজের মতো কিছু বলতে দেবে, কিংবা একজন সাংবাদিক তার মতো করে রিপোর্ট করবে, যা গণমানুষকে যুক্ত করবে- সেটা আপাতত আর হচ্ছে না। এটা নিয়ে কথা হচ্ছে অনেক; কিন্তু সমন্বিত কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ে আপাতত আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণও নেই।
ইমেইল: [email protected]
লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ