জাহাজের ধাক্কায় নৌকা ডুবে যাত্রী নিখোঁজ হন, নাম আসে না
ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে সুরভী-৭ নামের একটি লঞ্চের ধাক্কায় গত বছরের ৬ মার্চ নৌকায় থাকা একটি পরিবারের ছয় সদস্যের মৃত্যু হয়। এর কয়েক দিন পরেই গত বছরের ২১ জুন একইভাবে নৌকায় করে বুড়িগঙ্গা পার হওয়ার সময় পূবালী-৫ নামের একটি লঞ্চের ধাক্কায় দুই বোনের মৃত্যু হয়। দুজনই শিশু।
ঢাকার সদরঘাট নৌ থানার পুলিশ এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা-পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, সদরঘাটে নৌ-দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই ছোট নৌকার যাত্রী। লঞ্চ, ট্রলার, বালুবাহী জাহাজের ধাক্কায় এসব নৌকার যাত্রীরা হতাহত হচ্ছেন। কখনো মারা যান নৌকার মাঝিরাও।
ঢাকার সদরঘাট নৌ থানার খাতাপত্রের তথ্য বলছে, গত বছর (২০১৯ সালে) ঘাটে নৌ–দুর্ঘটনায় মারা যান ২৩ জন এবং ২০১৮ সালে মারা যান ১৩ জন। তবে চলতি বছরের ছয় মাসে নিহত হয়েছেন ৩৭ জন, যাঁদের মধ্যে ৩৪ জনই গত সোমবার ডুবে যাওয়া লঞ্চ মর্নিং বার্ডের যাত্রী। এদিকে সদরঘাটের নৌকার মাঝি, লঞ্চের কর্মচারী এবং মাঠপর্যায়ের বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, সদরঘাটে রাতের বেলা লঞ্চ, ট্রলার কিংবা বালুবাহী জাহাজের ধাক্কায় প্রায়ই নৌকা ডুবে যাত্রী নিখোঁজ হন। পরে হয়তো অজ্ঞাতনামা হিসেবে লাশ উদ্ধার হয়। সেই তথ্য পুলিশের নৌডুবির খাতায় আসে না।
বুড়িগঙ্গা এপার-ওপার ঢাকা আর কেরানীগঞ্জ। বেশির ভাগের গন্তব্য এপারের লালকুঠি, ওয়াইজঘাট থেকে ওপারের তেলঘাট। স্থানীয় লোকজনের নদীর এপার-ওপার করার প্রধান বাহন ছোট ছোট নৌকা। বাবুবাজার থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত দুই তীরে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শ নৌকা এভাবে চলাচল করে বলে ধারণা দিয়েছেন মাঝিরা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বুড়িগঙ্গায় এসব নৌকা চলে। পুলিশ ও নৌযানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব ছোট নৌকা মৃত্যু বাড়াচ্ছে। জীবন বাঁচাতে খেয়ানৌকা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জের বাসিন্দা আবদুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে এইটুকু ঘাট, অথচ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে বড় বড় লঞ্চ। লঞ্চগুলো এত বড় যে লঞ্চের বডি নদীর মাঝ বরাবর চলে আসে। আবার উল্টো দিকের ঘাটে অনেক লঞ্চ অলস বসে থাকে। বুড়িগঙ্গার দুই পাশের ঘাটে বড় বড় লঞ্চ যখন বাঁধা থাকে, তখন নদীর ভেতরে চলাচলের জায়গা অনেক কমে যায়। এর মধ্য দিয়ে যখন লঞ্চ চলাচল করে, তখন ঝুঁকি নিয়ে সেকেন্ডে সেকেন্ডে নৌকা পার হচ্ছে। প্রায় সময় এসব লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডোবে। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁরা বেঁচে যান, আর যাঁরা সাঁতার জানেন না, তাঁরা বুড়িগঙ্গায় ডুবে মারা যান। বছরের পর বছর এটাই হয়ে আসছে এই বুড়িগঙ্গায়। দেখার কেউ নেই।’
চাঁদপুর রুটের একটি লঞ্চের মাস্টার মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সদরঘাটে লঞ্চ নিয়ে ঢোকার পর অনেক সতর্ক থাকি। তারপরও দুর্ঘটনা হয়। নদীতে মুহূর্তে মুহূর্তে শত শত নৌকা চলাচল করে।’
রাতের বেলা বালুবাহী জাহাজ চলাচল নদীতে নিষিদ্ধ থাকলেও নৌ-পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক বালুবাহী লঞ্চ চলাচল করছে বলে জানান একাধিক লঞ্চের মাস্টার।
সদরঘাট নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম বলেন, সদরঘাটকেন্দ্রিক নৌ-দুর্ঘটনার বড় কারণ নৌকার মাঝিদের অসতর্কতা। লঞ্চের পেছনে চলে আসেন নৌকার মাঝিরা। তখন নৌকার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লঞ্চের ধাক্কা খেলে অনেক যাত্রী বুড়িগঙ্গায় ডুবে মারা যান।