করোনাকালে করণীয় নিয়ে যা বললেন চার বিশিষ্টজন
নানা সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনার মধ্যে এই অতিমারিতে সরকার নিজের অবস্থান থেকে নাগরিকদের সুরক্ষার চেষ্টা করছে। সঙ্গে আছে বেসরকারি, ব্যক্তি ও সামাজিক বিভিন্ন উদ্য্তু এই পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকদের করণীয় কী? চার বিশিষ্ট নাগরিক এ নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
আমরা যেন নিজেকে ফাঁকি না দেই
অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম
মানুষের জীবনযাপন, অভ্যাস ও ব্যক্তিগত আচরণে পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আগে তো কাপড়চোপড় পরেই আমরা বাইরে বের হতাম। এখন সঙ্গে মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজারসহ ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা ভাবতে হচ্ছে। এই ভাবনা থেকে সহজে মুক্তি আসবে বলে মনে হয় না।
সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে—এগুলো কিন্তু নতুন বিষয় নয়। ব্যবসায়িক কারণে হলেও সাবান কোম্পানিগুলো এ কথা বলে আসছে। হাত ধোয়া দিবস কিন্তু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বছরে একবার পালন করা হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে এটা এখন বাধ্যতামূলক, প্রতিদিনে প্রয়োজন অনুযায়ী অনেকবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
এখনো নাগরিকদের অনেকে মাস্ক না পরে মনে করে পুলিশকে ফাঁকি দিয়েছে। আসলে যিনি মাস্ক পরলেন না, তিনিই কিন্তু নিজেকে ঠকালেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা নিয়ে বড় রকম প্রশ্ন আছে। এখন আমরা ডাক্তার, নার্স নিয়োগ করছি। তাহলে আগে করিনি কেন? আগে কি প্রয়োজন ছিল না, এত দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল কেন? এমন অনেক প্রশ্ন তোলা যাবে, যার সদুত্তর সংশ্লিষ্টদেরও জানা নেই।
আরেকটি প্রসঙ্গ হচ্ছে, সবাই বলছে টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারলাম না। র্যাপিড টেস্ট তো চালুই করতে পারলাম না।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ খুবই কম। এমনকি ভারত, পাকিস্তান ও মালদ্বীপের চেয়েও কম। একদিকে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কম, আরেকদিকে এর মধ্যেও আছে দুর্নীতি। আবার যেটুকু বরাদ্দ তার সবটা অনেক সময় খরচও হয় না।
এসব কারণে স্বাস্থ্য খাতের কোমর ভেঙে গেছে। এই কোমর সহজে সোজা হবে বলে
মনে হয় না। এর কারণ আমাদের দেশে ইনস্টিটিউশন তৈরি হয়নি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি করে লেজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দলীয় পরিচয়ের এই লেজ নিয়োগ-বদলি, ঠিকাদারি, কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গে আপস করে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে চলতে হয়। এই আপস করতে পারিনি বলেই তো উপাচার্যের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলাম।
রাজনীতি একটি বড় বিষয়, রাজনীতি ছাড়া দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি হবে না। কিন্তু সব জায়গায় রাজনীতি বা রাজনীতির নামে দুর্নীতি বা অনিয়ম ঢুকে পড়লে কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলবে না।
এখনকার পরিস্থিতিতে সরকার তার মতো চেষ্টা করছে, নাগরিকদের দায়িত্ব সরকারকে সহায়তা করার মাধ্যমে নিজেকে সহায়তা করা।
সুরক্ষার দায়িত্ব কিন্তু নিজের কাছে
অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ
সরকার ঘরে থাকতে বলল কি না, লকডাউন দিল কি না—এসব নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই। যে পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়েছি, তাতে নিজ দায়িত্বে নিজেকেই অবরুদ্ধ করতে হবে। এই সময়ে নিজের জীবনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব অন্যের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
আমি ভালো থাকলে আমার পরিবার ভালো থাকবে, আমার পরিবার ভালো থাকলে পাড়া-প্রতিবেশী, মহল্লা বা গ্রাম—সর্বোপরি দেশ ভালো থাকবে। একজন নাগরিক হিসেবে নিজের কথা ভেবে দেশকে রক্ষা করাই এখন আমাদের বড় দায়িত্ব। এ জন্য মাস্ক পরব, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখব, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলব। জরুরি কাজে বাইরে গেলেও যেন দ্রুত ঘরে ফিরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন নেই। কবে তৈরি হবে, সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। রাত পোহালে যদি ভ্যাকসিন পেয়ে যেতাম, এমন আশাবাদ আছে অনেকের মধ্যে। বাস্তবে যত আশা করি না কেন, এটা তৈরি হয়ে দেশে আসতে সময় লাগবে। তাই প্রতিকার ও প্রতিরোধই এই ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার উপায়। তাই যেকোনো মূল্যে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন, আপনার এই স্বার্থপরতা অন্যকে সুরক্ষা দেবে।
একটা বিষয় কিন্তু সবার কাছেই পরিষ্কার, আপনি আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাওয়াটা কঠিন। কারণ, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের জনসংখ্যা বা প্রয়োজন অনুপাতে হাসপাতাল, বেড, ভেন্টিলেটর, ডাক্তার ও নার্স নেই। টাকা থাকলেও সুচিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তা অনেক ক্ষেত্রে নেই। তাই সতর্কতাই নাগরিককে সুরক্ষা দিতে পারে।
আসুন আমরা রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত ও দোকানপাটে দূরত্ব বজায় রেখে চলি। গাদাগাদি করে ফেরি, গণপরিবহন বা যানবাহনে চলব না।
সরকার ও প্রশাসন নিজের মতো করে চেষ্টা করছে। সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও হয়তো চলছে। সরকারের ভূমিকার মধ্যে চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী, র্যাব-পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সব নিরাপত্তাকর্মী এবং গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টি আরও জোরদার করতে হবে। তাঁদের উৎসাহ দিতে হবে, সাহস জোগাতে হবে এবং মনোবল বজায় রাখতে হবে।
এই মহামারি থেকে কবে আমরা মুক্তি পাব, কেউ জানি না, করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করেই হয়তো বাঁচতে হবে।