নুসরাতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ভাইয়ের আবেগঘন স্ট্যাটাস
দেখতে দেখতে একটি বছর পার হয়ে গেল। যদিও এই তিন শ পয়ষট্টি দিন আমাদের কাছে ছিল তিন শ পয়ষট্টিটি রক্তগঙ্গা পাড়ি দেওয়ার সমান। প্রতিদিন অবিরত অশ্রুর ধারা বহে গেছে নিরবধি। জানি না আর কতদিন এই উপলব্ধি আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। গত বছর ১০ এপ্রিল এই দিনে আমার আপু হায়েনাসদৃশ কিছু নরপশুর রক্তলোলুপতার শিকার হয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছে। সবাই জানেন, এর আগে জেলে থাকা সাবেক অধ্যক্ষ সিরাজের নির্দেশে ৬ এপ্রিল নিজের মাদরাসায় আমার আপুর গায়ে কেরোসিন ঢেলে নির্মমভাবে পুড়িয়ে দেয় খুনিরা। কিন্তু আমার বোন মাথা নত করেনি। আমার আপু হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহী এক প্রতীক। আপুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আপুকে উৎসর্গ করে আমার লেখা। হে আপুনি হায়েনাদের নিক্ষিপ্ত অগ্নিবাণের দুঃসহ যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়েছে আপনার সারা দেহ। আপনার অসহ্য শারীরিক ও মানুষিক যন্ত্রণার অবসান করেছিল মৃত্যু এসে। কিন্তু আপনার এ মৃত্যু লাখো-কোটি মানুষের বিবেককে দিয়েছে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। এ মৃত্যু বিবেকবান সকল মানুষকে করেছে হায়েনাদের প্রতি ক্রোধান্বিত, ক্ষুব্ধ। পাশাপাশি তাদের অন্তরকে করেছে বেদনায় ভারাক্রান্ত। আপনার এ মৃত্যু কাঁদিয়েছে সারা দেশকে। হে আপুনি, আপনার এ বিদায় সারাদেশসহ পৃথিবীর মানুষকে করেছে তীব্র শোকাকুল। অনেকেই জানিয়েছে মাতৃবিয়োগের মতো শোকের বেদনায় নিমজ্জিত ছিলেন তারা। তাদের অন্তরকে করেছে শূন্যতার হাহাকারে পরিপূর্ণ। আপনি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছেন আমাদের সাহসের আরেক নাম। বাংলাদেশের নিপীরিত হাজারো অভাগীর কাছে হয়ে উঠেছেন বলিষ্ঠ প্রেরণা। হে আপুনি, আপনার হত্যাকারকদের উদ্দেশ্যে দেশবাসী দিয়েছে অভিশপ্ত, আর করেছে তাদের মনের ঘৃণার উদগীরণ। জীবনের পড়ন্ত বেলায় রোগ পীড়িত শরীরেও অনেকেই এসেছে আপনার জন্মভূমিতে, আপনার অন্তিম শয়ানের স্থান সোনাগাজীর উত্তর চরচান্দিয়ায়। আপনি প্রতিদিন যে পথে যেতেন আপনার বিদ্যাপীঠে, যে পথে ছিল আপনার চলাচল, বাড়ির আঙিনায় যেখানে নিত্য পড়ত আপনার পদচিহ্ন। সবাই হেঁটেছে সেসব পথে। যেন তারা খুঁজছে তাদের প্রিয় স্বজনকে। পেতে চেয়েছিল তারা আপনার স্মৃতির স্পর্শ। হে আপুনি, আপনি এক আত্মবিশ্বাসী, সাহসী প্রতীবাদী নারী। একথা প্রধানমন্ত্রীসহ আখ্যায়িত করেছে সকলেই। আপনি এ যুগের সুলতানা রাজিয়া, আপনি একালের বেগম রোকেয়া। আপনার সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ কত কথা যে বলেছে আপনার সঙ্গে। বেদনার নীল রঙে আর প্রচণ্ড আবেগে আক্রান্ত হয়ে এক বুক শূন্যতার হাহাকার নিয়ে উত্তর চরচান্দিয়া ছেড়ে লাখো মানুষ ফিরে গিয়েছে তাদের নিজ আবাসে। কিন্তু তারা আপনাকে একটুও ভুলেনি। আপনি মানুষের মনে আছেন চির জাগরূক হয়ে। এ দেশের প্রতিবাদী নারীদের তালিকায় লেখা রবে আপনার নাম। আপুনি, আমার হাতটা কাঁপছে, আর লিখতে পারছি না। আপনার অজস্র স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছি আমি। মাথার ভেতর তোলপাড় করছে ঘটনা প্রবাহ। ভেবে পাচ্ছি না কি লিখবো। বোধহয় এই লেখাটিতে আপনাকে কোনো সম্ভাষণ জানাতে পারলাম না। কারণ, আপনাকে কোন সম্ভাষণে সম্ভাষিত করবো আমি বুঝতে পারছি না। যাই করি না কেন তা আপনার জন্য অতি নগণ্য হয়ে যাবে আপুনি। আপনি বীরাঙ্গনার মতো জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন। আপনার এই আত্মদান, এই লড়াইকে দেশবাসী ব্যর্থ হতে দেয়নি। আপনার খুনিরা সর্বোচ্চ শাস্তির অপেক্ষায়।