
ছবি সংগৃহীত
প্রিয় গন্তব্য: সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির, সুপ্রাচীন এক স্থাপনা
আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০২:৪৬
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়া থেকে! ছবি: ডিসকভার বাংলাদেশ।
(প্রিয়.কম): সীতাকুণ্ড নামটা আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাইল তিরিশ উত্তরে গেলেই জায়গাটা। আবার ঢাকা থেকে যারা যান, তারা চট্টগ্রামে প্রবেশ করার আগে এটা পার হয়েই চলে যান। সীতাকুণ্ডে দেখার মত অনেক কিছুই আছে, তবে আজকের বিষয় হল চন্দ্রনাথ মন্দির।
চন্দ্রনাথ পাহাড় মীরসরাই রেঞ্জ এর একটি পাহাড়, আর এই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির। সীতাকুণ্ড অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক আধার। এ এলাকাকে হিন্দুদের বড় তীর্থস্থান বলা হয়। এখানের সর্বোচ্চ পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির । এর পাশাপাশি আরও অনেক মন্দির আছে এ এলাকায়। এখানে হিন্দু পবিত্র গ্রন্থসমূহ অনুসারে সতী দেবীর দক্ষিণ হস্ত পতিত হয়েছিল। সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির তীর্থযাত্রীদের জন্য এক পবিত্র স্থান। এর পুরনো নাম ছিল "সীতার কুণ্ড মন্দির"। রাজমালা অনুসারে প্রায় ৮০০ বছর পূর্বে গৌরের বিখ্যাত আদিসুরের বংশধর রাজা বিশ্বম্ভর সমুদ্রপথে চন্দ্রনাথ মন্দিরে পৌঁছার চেষ্টা করেন। ত্রিপুরার শাসক ধন মাণিক্য এ মন্দির থেকে শিবের মূর্তি তার রাজ্যে সরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
বিভিন্ন তথ্য অনুসারে এখানের ইতিহাস সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য জানা যায়। প্রাচীন নব্য-প্রস্তর যুগে সীতাকুণ্ডে মানুষের বসবাস শুরু হয় বলে ধারনা করা হয়। এখান থেকে আবিষ্কৃত প্রস্তর যুগের আসামিয় জনগোষ্ঠীর হাতিয়ার গুলো তারই স্বাক্ষর বহন করে। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দীতে সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিল। এর পরের শতাব্দীতে এই অঞ্চলের শাসনভার চলে যায় পাল সম্রাট ধর্মপাল দ্বারা এর হাতে (৭৭০-৮১০ খ্রীঃ)। সোনারগাঁও এর সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ্ (১৩৩৮-১৩৪৯ খ্রীঃ) ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে এ অঞ্চল অধিগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুর বংশের শের শাহ্ সূরির নিকট বাংলার সুলতানি বংশের শেষ সুলতান সুলতান গীয়াস উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ্ পরাজিত হলে হলে এই এলাকা আরাকান রাজ্যের হাতে চলে যায় এবং আরাকানিদের বংশধররা এই অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। পরবর্তীতে পর্তুগীজরাও আরাকানিদের শাসনকাজে ভাগ বসায় এবং ১৫৩৮ খ্রী: থেকে ১৬৬৬ খ্রী: পর্যন্ত এই অঞ্চল পর্তুগীজ ও আরাকানি বংশধররা একসাথে শাসন করে। প্রায় ১২৮ বছরের রাজত্ব শেষে ১৯৬৬ খ্রী: মুঘল সেনাপতি বুজরুগ উন্মে খান আরাকানিদের এবং পর্তুগীজদের হটিয়ে এই অঞ্চল দখল করে নেন।
এই চন্দ্রনাথ মন্দিরে প্রতিবছর শিবরাত্রি তথা শিবর্তুদশী তিথিতে বিশেষ পূজা হয়; এই পূজাকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডে বিশাল মেলা হয়। সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড় এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর বাংলা ফাল্গুন মাসে (ইংরেজি ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস) বড় ধরনের একটি মেলার আয়োজন করে থাকেন। যেটি শিবচর্তুদর্শী মেলা নামে পরিচিত। এই মেলায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য সাধু এবং নারী-পুরুষ যোগদান করেন।
কোথায়: সীতাকুণ্ড বাজার থেকে চার কিলোমিটার পূর্বে গেলে চন্দ্রনাথ পাহাড় শুরু হয়। সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম থেকে তিরিশ কিলোমিটার উত্তরে পড়ে। ঢাকা থেকে আসলে চট্টগ্রাম ঢোকার আগেই সীতাকুণ্ড পড়বে। সীতাকুণ্ড শহরের পূর্বে অবস্থিত চন্দ্রনাথ ১১৫২ ফুট উঁচু, রাজবাড়ি টিলার উচ্চতা ৮৮৯ ফুট এবং সাজি-ঢালার উচ্চতা ৮০১ ফুট। চট্টগ্রাম শহরের কাছাকাছি এসে এই পাহাড়ের উচ্চতা অনেক কমে এসেছে। এই সীতাকুণ্ড পাহাড়ের সারি ধরে একে একে সহস্রধারা আর সুপ্ত ধারা নামের দুটি জলপ্রপাত।
কিভাবে: যারা ঢাকা থেকে যাবেন, তারা চট্টগ্রাম-গামী যে কোন বাসে রওনা হতে পারেন। বাসের সুপারভাইজারকে বললেই সে সীতাকুণ্ড বাজারে নামিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পারবে। সেখানে নামার পরে আপনি চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গোঁড়া পর্যন্ত রিকশায় যেতে পারেন। তবে হাতে সময় থাকলে পায়ে হেঁটে যাওয়াটা উপভোগ্য হতে পারে। যাবার পথে আপনি অনেক কিছুই দেখতে পারবেন পায়ে হেঁটে গেলে। পাহাড়ের গোঁড়ায় পৌঁছে সিঁড়ি বেয়ে আপনি উঠে যেতে থাকবেন উপরে। এই এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে ওঠাটাই একটা এডভেঞ্চার বিশেষ! সাবধানে সময় নিয়ে এবং বিশ্রাম নিয়ে উঠে গেলে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে আপনার পৌঁছতে। প্রায় ১১০০ ফুট এর মত উচ্চতা আপনাকে উঠতে হবে বেশ কম সময়ে, তাই নিয়মিত ভাবে বিশ্রাম নেয়াটা ভাল হবে।
সীতাকুণ্ড ইকো পার্কের ভেতর দিয়ে যাবার আর একটা উপায় আছে, কিন্তু সেটা একটু ঘুর পথে হয়ে যায় আর নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তাই এই পথটাই ভাল হবে অন্যটার তুলনায়।
নিচ থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চুড়ায় মন্দির। ছবি: ডিসকভার বাংলাদেশ।
কি দেখবেন: সীতাকুণ্ড কলেজ রোড দিয়ে যাবার পথে আপনি পাবেন কয়েকটা ছোট ছোট মন্দির, উঠে যাবার পথে হয়ত দেখতে পারবেন একটু দুটা পরিবার উঠে যাচ্ছে পাহাড়ে পূজা দিতে। উঠতে উঠতেই চারপাশের পরিবেশের পরিবর্তন লক্ষ করে হয়ত একটু দাঁড়াবেন। যতই উঠতে থাকবেন, ততই ওঠা আরও বেশি কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। তবে তাড়াহুড়ো না করে থেমে থেমে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে আপনি সময় নিয়ে উঠে গেলে সময়টাও উপভোগ করতে পারবেন আবার ক্লান্তও হবেন না বেশি একটা।
পাহাড চুড়ায় বিরূপাক্ষ মন্দির। ছবি: ডিসকভার বাংলাদেশ।
পাহাড়ের সবচেয়ে অসাধারণ ভিউটা পাবেন বর্ষায় গেলে, তবে শীতেও কম যায় না এই এলাকার প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো। উপরে উঠে গেলে দেখবেন ডানে বামে চিরসবুজ পাহাড়ের সারি। সামনে একটু নিচু এক পাহাড়ের চূড়ায় একটা মন্দির ছোট্ট খেলনা বিন্দুর মত দেখাবে। আর একটু সামনে তাকালে বঙ্গোপসাগরের অংশ চোখে পড়বে। তারপরে দিগন্ত রেখায় লম্বা কালো একটা টান, ক্রমশ সমুদ্রতলে হারিয়ে যেতে থাকা দ্বীপ ভূখণ্ড ‘সন্দীপ’। চুড়ায় ছোট্ট একটা মন্দির পাবেন। এটাই চন্দ্রনাথ মন্দির।
নেমে আসার সময় আপনাকে হতে হবে আরও সাবধান, কারণ এই সময়ই অনেকে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসেন। যেভাবে সাবধানে উঠেছেন, সেভাবে সাবধানে, বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে নেমে আসুন।
উপরে ওঠার সময় যদি টোকেন সংগ্রহ করে যান, তাহলে নিচে ফিরে এসে শঙ্কর মঠে খেতে পারবেন দুপুরের খাবার। অনেকে বলে এই খাবার না খেলে নাকি চন্দ্রনাথ ভ্রমণ সার্থক হয় না!
ফিরতি পথে রিকশায় করে সীতাকুণ্ডে চলে যেতে পারেন! সেখান থেকে যেতে পারেন চট্টগ্রাম অথবা সীতাকুণ্ড বাজারেই যোগাযোগ করলে ঢাকা গামী বাস পেয়ে যাবেন!
এক দিনের মাঝে ভ্রমণ সম্পূর্ণ করতে এটা হতে পারে একটা ভাল জায়গা। খুব সকালের বাসে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সবকিছু দেখে বিকেলের বাসে ফেরত যেতে পারবেন ঢাকা থেকে। আর যারা আশে পাশের এলাকায় আছেন, তাদের জন্য বিষয়টা আরও সহজ।
সম্পাদনা: প্রিয় ট্রাভেল/ ড. জিনিয়া রহমান।
আপনাদের মতামত জানাতে ই মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।