
ছবি সংগৃহীত
জগদ্দল মহাবিহার কি প্রাচীন রাজধানী রামাবতী নগর?
আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:২৮
জগদ্দল বিহার, নওগাঁ। ছবি: প্রিয়.কম
(আশরাফুল নয়ন, নওগাঁ) নওগাঁর জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা ধামইরহাট। এ উপজেলার ধামইরহাট ইউনিয়নের মধ্যে অবস্থিত জগদ্দল বিহার। অনেক গবেষণার পর প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ১৯৯৬ সালে উৎখনন কাজ শুরু করে। তিন ধাপে চালানো খনন কাজে বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন ধরনের মুর্তিসহ মূল্যবান নিদর্শন। গবেষকরা বলছেন দ্বাদশ শতকের কবি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিতম গ্রন্থে উল্লেখিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী রামাবতী নগরের ধারনাটি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে এসেছে এই বিহারে। তবে তিন বছর ধরে থেমে আছে জগদ্দলের উৎখননের কাজ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জগদ্দল বিহারের উৎখননের বিষয়টি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর আন্তরিক। দ্রুতই আবার এটির খনন ও সংস্কার কাজ শুরু হবে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, জগদ্দল বিহারের প্রথম উৎখনন শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। মাঝে কিছুদিন বন্ধ থাকে। ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর আবারও শুরু হয় খনন কাজ। সর্বশেষ তৃতীয় পর্যায়ে খনন চালানো হয় ২০১৩ সালে। চলে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত।
ওই সময় খনন করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে বুদ্ধমূর্তিসহ একের পর এক প্রাচীন নিদর্শন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রাপ্ত বৌদ্ধ বিহারগুলোর মধ্যে আবারও মিলেছে বিহারের ছাদের স্বরুপ।
তৃতীয় পর্যায়ের উৎখননে তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত পাহাড়পুর প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগের কর্মকর্তা মাহাবুব আলম জানান, এখানেই রয়েছে পাল সম্রাট রামপালের সেই হারিয়ে যাওয়া রামাবতী নগর।
২০১৩ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে জগদ্দল বিহারের পশ্চিম বাহুর একটি ভিক্ষু কক্ষে খনন করতে গিয়ে একটি কুলাঙ্গির মধ্যে পাওয়া যায় ১৪টি ব্রোঞ্জের বৌদ্ধ মুর্তি। বিহারের মেঝে থেকে বিভিন্ন স্তরে ২৪ থেকে ২৫ ফুট উঁচু ছিল। জগদ্দলের পুর্বে নিকেশ্বর বা নিকাই শহর ও পশ্চিমে জগৎ নগর নামে বিশাল জনপদ ছিল। এখানে কর্মরত প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের কর্মকর্তারা অনেকটাই নিশ্চিত সেই জগদ্দল বিহারই লোটাস বিহার (পদ্ম মহাবিহার) বিহারটির আকৃতি দেখে লোটাস বৌদ্ধ বিহার বলে প্রাথমিকভাবে আখ্যায়িত করেছেন উদ্ধারকারীর প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ দল। তারা বলেছেন বরেন্দ্রভুমি তথা দেশের ৯শ বছরের প্রাচীন স্থাপত্য শিল্প জগদ্দল লোটাস মহাবিহার নতুন সংযোজন।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান সাদেকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সম্ভাব্য তালিকায় জগদ্দল মহাবিহারের নাম রয়েছে। এবার খননে পাওয়া গেছে বিহারের ভগ্নাংশ। নির্দিষ্ট দুরত্বে পিলারের সারি পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে বিভিন্ন সাইজের বিপুল সংখ্যাক আইরন নেইল (তারাকাটা) বিহারের উত্তর বাহু খননে বেরিয়েছে পোড়া মাটির টেরাকোটা। যা বিহারের দেয়ালে সারিবদ্ধভাবে লাগানো রয়েছে। এ পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে ৩৩টি ভিক্ষু কক্ষ। প্রতিটি কক্ষেই বৌদ্ধ মূর্তি রাখার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল। বিহারের পূর্বমূখে রয়েছে প্রধান প্রবেশ দ্বার। প্রথমে পাওয়া যায় পাকা চত্তর। এরপর ৮মিটার দৈর্ঘ্যরে বাহুসহ মূল বিহারের প্রবেশের অনুমতি দ্বার। এর পর রয়েছে হল ঘর। এ হল ঘরে চারটি গ্রানাইট পাথরের পিলার উদ্ধার করা হয়েছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে কোন বৌদ্ধ বিহারে প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন গ্রানাইট পাথরের পিলার দেখা যায়নি।
তিনি আরও জানান, নওগাঁর পাহারপুর বৌদ্ধ বিহার, কুমিল্লার শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, দিনাজপুরের শীতাকোট বিহারসহ দেশের কোন বিহারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ছাদের কি বৈশিষ্ট ছিল তার স্বরুপ কি ছিল তা জানা যায়নি। তবে এবার জগদ্দল পদ্ম মহাবিহারে এই প্রথম ছাদের পতিত ভগ্নাংশ আবিষ্কৃত হল। যার পুরুত্ব প্রায় ৬০ সে.মি। এতে করে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারর ছাদের স্বরুপ সম্পর্কে সম্যক ধারনা পাওয়া গেছে। যা প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ ও স্থাপতিদের গবেষনায় নতুন দ্বার উম্মোচিত হবে। ছাদের বড় বড় ইটের খোয়া চুন সুড়কি, কাদামাটির সঙ্গে উদ্ভিদ ও প্রাণীজ পদার্থের মিশ্রনে ছাদ মজবুত করা হয়েছিল। বিহারটি দ্বিতীয়বার সংস্কারের সময় অথবা নির্মাণের সময় গ্রানাইট পাথরের উপর চুন সুড়কির পলেস্তার করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিহারের বাইরের দেয়াল চুন বালির মিশ্রনে কারুকার্যে সাদা রং এর লতা ,পাতা, ফুল জীববস্তুর অলংকরণ ছিল। যার নমুনা পাওয়া গেছে দ্বাদশ শতকের বিখ্যাত কবি সান্ধ্যাকর নন্দী কতৃর্ক সংস্কৃত ভাষায় রচিত রাম চরিতম গ্রন্থের এসব অলংকরনের কথা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান জানান, জগদ্দলে উৎখনন অনুসন্ধানে যে সব তথ্য ও নির্দেশন পাওয়া গেছে তাতে রামাবতী নগরের ধারনাটি অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এটি পুর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত হতে বিহারটি পুর্ণাঙ্গ খনন, সংঙ্কার এবং আরও গবেষণা করা দরকার। ইতিহাসে জগদ্দল নামে বেশ কয়েকটি স্থানের নাম পাওয়া যায়। নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় অবস্থিত জগদ্দলের সংগে রামাবতীর যে মিল পাওয়া যায় তাতে পুর্ণাঙ্গ খনন ও অনুসন্ধান চালানো হলে সেই বির্তকের অবসান ঘটবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
ধামইরহাট পৌরসভার মেয়র রেজুয়ান হোসেন ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান বলেন, বিহারের পাশে একটি জাতীয় উদ্যান আছে। সেখানে একটি জাদুঘর নির্মাণ করে এ বিহার থেকে উদ্ধার করা মুর্তি ও অন্যান্য মুল্যবান সরঞ্জাম সংরক্ষণ করার দাবি জানান।
এ ছাড়া এখানকার সচেতন ব্যাক্তিরা পুণরায় দ্রুত উৎখনন কাজ শুরু করার দাবি জানান।
পাহাড়পুর জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান সাদেকুল ইসলাম বলেন, জগদ্দল বিহারের উৎখননের বিষয়টি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর আন্তরিক রয়েছে। দ্রুতই আবার এটির উৎখনন ও সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।
প্রিয় সংবাদ/জেআইজে/এফকে