ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি

তানজিল রিমন
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৫:১৮
আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৫:১৮

ডেঙ্গু এখন আর শহুরে রোগ নয়। রাজধানী ঢাকার বাইরেও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু এবং এই রোগের বাহক এডিস মশা। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিস নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। যতদিন না পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে, ততদিন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ১২ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১৪ হাজার ৪৬০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৫৫ জনের।

২০২৫ সালের ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের অগ্রগতি বিশ্লেষণ করলে মাস অনুযায়ী প্রবণতা ও গতিপথ বোঝা যায়। বছরের শুরুর মাসগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। যেমন- জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন আক্রান্ত ও ১০ জনের মৃত্যু হয়, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন আক্রান্ত ও ৩ জনের মৃত্যু, মার্চে ৩৩৬ জন আক্রান্ত, এপ্রিলে ৭০১ জন আক্রান্ত ও ৭ জনের মৃত্যু এবং মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন আক্রান্ত ও ৩ জনের মৃত্যু হয়। জুনে নাটকীয়ভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সে মাসে ৫ হাজার ৯৫১ জন নতুন আক্রান্ত এবং ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই বৃদ্ধিই বলছে জুন মাসে প্রাদুর্ভাব উচ্চ পর্যায়ে ছিল। জুলাইয়ে এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে এবং দৈনিক নতুন আক্রান্তের সংখ্যা প্রায়শই ৩০০-৪০০ ছাড়িয়ে গেছে। যেমন- ৭ জুলাই ৪৯২ জন, ৮ জুলাই ৪২৫ জন, ৯ জুলাই ৪০৬ জন, ১০ জুলাই ৩৩৭ জন ও ১২ জুলাই ৩৯১ জন আক্রান্ত হয়েছে।

প্রাদুর্ভাবটি সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত দেশের ৬০টি জেলা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। এটি গত বছরগুলোর (২০২৪ সালে ৫৪টি জেলা ও ২০২৩ সালে ৫৬টি জেলা) তুলনায় রোগের ভৌগোলিক বিস্তার বৃদ্ধি করেছে। দৈনিক নতুন আক্রান্তের সংখ্যায় দেখা যায়, একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঢাকার বাইরে থেকে আসছে। উদাহরণ হিসেবে ১১ জুলাইয়ের সংখ্যা তুলে ধরা যায়, এই দিন ঢাকার বাইরে হাসপাতালগুলোতে ১১৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন, যেখানে ঢাকায় ভর্তি হয়েছিলেন ২৫ জন ।

২০২৫ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরের আক্রান্তের চিত্র। চিত্রটি এআই দিয়ে করা হয়েছে।

ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি বিভাগ এবং জেলা গুরুতর প্রাদুর্ভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। বরিশাল বিভাগ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৯ জুলাইয়ের আশেপাশে ১২০ জন নতুন রোগী এবং একই তারিখ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে । অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত বিভাগ ও জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম (৯ জুলাইয়ের আশেপাশে ৯৮ জন নতুন রোগী ও ৪ জনের মৃত্যু), খুলনা (১৮ জন নতুন রোগী ও ৪ জনের মৃত্যু), রাজশাহী (৪৮ জন নতুন রোগী ও ২ জনের মৃত্যু), ময়মনসিংহ (১১ জন নতুন রোগী ও ১ জন মৃত্যু) এবং সিলেট (১ জন নতুন রোগী)। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলাকে একটি স্থানীয় হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে এই মৌসুমে সরকারি হাসপাতালে অন্তত ২০০ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ।  

ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সাধারণত মানুষের বাড়ি-ঘর ও অফিসে ফেলে রাখা পাত্র, ফুলের টব, নির্মাণাধীন ভবনের জমে থাকা পানিতে বংশবিস্তার করে। ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা পর্যন্ত পুরো বিকাশে সাধারণত ৭-১০ দিন সময় লাগে। এরপর সেই মশা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

বিভাগ অনুযায়ী ২০২৫ সালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চিত্র। চিত্রটি এআই দিয়ে করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার প্রিয় নিউজ-কে বলেন, “এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে এই মুহূর্তে প্রয়োজন সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ। এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ জনগণকে ছাড়া সম্ভব না। কারণ নিজের বাড়ি, বাড়ির আঙিনায় যে ছোট ছোট পাত্র থাকে, সেখানে এডিস মশা হয়। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, ওই পাত্রগুলো যেন না থাকে। এজন্যই সাধারণ মানুষকে মশক নিধন কার্যক্রমে যুক্ত করা জরুরি। কারণ সিটি করপোরেশনের লোকরা তো বাড়ির ভেতর গিয়ে দেখে না। তাদের ওই পরিমাণ লোকবলও নেই। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের সহায়তায় বাড়িতে এডিসের প্রজননস্থল খোঁজা, ধ্বংস করা ও লার্ভা নিধনের ওষুধ ছিটাতে হবে। এ ছাড়াও উড়ন্ত মশা নিশনে ‘হটস্পট ম্যানেজমেন্ট’ অর্থাৎ যে বাড়িতে ডেঙ্গু আক্রান্ত আছে, তার ২০০ মিটারের মধ্যে ফগিং করে এডিস মশা যেন বেঁচে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব গবেষণাগার মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এই কয়েকটি বিষয় নিয়ে মাল্টিভেরিয়েট অ্যানালাইসিস করে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করে। যার মাধ্যমে ডেঙ্গু সম্পর্কে আগাম ধারণা দিতে পারে।

ড. কবিরুল বাশার বলেন, “আমাদের গবেষণাগার থেকে এ পর্যন্ত আমরা যে আগাম তথ্য দিয়েছি তার সবগুলোই সঠিক হয়েছে। আমাদের বর্তমান ফোরকাস্টিং মডেল বলছে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ ঘটাতে না পারলে এ বছরও বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। বিশেষ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।”

অনেক সময় ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণ লক্ষণগুলো হালকাভাবে দেখা দিতে পারে। চিত্রটি এআই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

ডেঙ্গু যেহেতু এখন সিটি করপোরেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাই ঢাকার বাইরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে মশক নিধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন ডা. কবিরুল বাশার।

মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে বের হতে হবে বলে মনে করছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। এই জনস্বাস্থ্যবিদ প্রিয় নিউজকে বলেন, “এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে এমন একটি মডেল দাঁড় করাতে হবে, যেখানে বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ যুক্ত থাকবে এবং মন্ত্রী পদমর্যাদার কেউ সম্পৃক্ত থাকবে। তারপর এলাকাভিত্তিক এডিসের বংশবিস্তার প্রতিরোধে একযোগে কাজ করতে হবে।”

অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রস্তুত রাখতে হবে। ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “সারা দেশের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকতে হবে। পরীক্ষা করার জন্য কিটের জন্য সংকট না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে এবং সরকারিভাবে ডেঙ্গুর টেস্ট ও চিকিৎসা ফ্রি করতে হবে।”

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন ভয়াবহ না হয়, সেজন্য দুই ধাপে চিকিৎসাব্যবস্থা সাজাতে হবে। প্রথমে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে হবে এবং তাদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তাহলে রোগীদের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হবে না। কিন্তু টেস্ট না করায় অনেকে আক্রান্ত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছার পর চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যান। ততক্ষণে তাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। এজন্য ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা হলে সেকেন্ডারি পর্যায়ে (ঝুঁকিপূর্ণ) রোগী কম হবে। দ্বিতীয় ধাপে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও যুক্ত করতে হবে।”

আবার ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ায় রোগীর বাড়ি এবং আশপাশে এডিস মশা ও তার প্রজননস্থল ধ্বংস করা সহজ হবে বলে মনে করেন ডা. মুশতাক হোসেন।