মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিনই ভর্তি হতে আসছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত নতুন নতুন রোগী
চলতি বছর ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু কেন?
আপডেট: ১৮ জুন ২০২৩, ১৮:০০
চলতি বছর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা অন্য বছরের তুলনায় কয়েকগুণ। বর্ষা মৌসুমের আগেই এ বছর ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। গবেষকরা বলছেন, ডেঙ্গুর নতুন ধরনের কারণে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে কার্যকর উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। না হলে এ বছর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০৫ জন রোগী এবং মৃত্যু হয়েছে একজনের। এ নিয়ে চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে জুনের ১৮ তারিখ পর্যন্ত মোট চার হাজার ৯০৮ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ে তাদের মধ্যে ৩৪ জন মারা গেছেন। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা উভয়ই চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনেই বেশি। দুই হাজার ৮৮৬ জন জুনেই আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ২১ জন। যেটি গত কয়েক বছরের তুলনায় কয়েকগুণ। ২০২২ সালের জুনে শুধু একজনের মৃত্যু হয়। ওই সময় ৭৩৭ জনের শরীরে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। ২০২১ সালের জুনে ২৭২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। তখন কারও মৃত্যু হয়নি। ২০২০ সালের জুনেও কারও মৃত্যু হয়নি। সে সময় রোগী শনাক্ত হয়েছিল ২০ জন। ২০১৯ সালের জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। ওই মাসে সাতজনের মৃত্যু হয়েছিল।
সাধারণত ডেঙ্গু মৌসুম শুরু হয় বর্ষার সময়। কিন্তু চলতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুর আগেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গুর ভিন্ন ধরনের কারণে চলতি বছর পরিস্থিতি নাজুক।
নতুন ধরনে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে?
ডেঙ্গুর ধরন হচ্ছে চারটি। এগুলো হচ্ছে ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। এর কোনো একটি ধরনের একবার আক্রান্ত হলে সেটি শরীরে সেই ধরনের জন্য প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্য নতুন আরেকটি ধরনে আক্রান্ত হতে পারে। এভার একজন একই ধরনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হলেও ভিন্ন ভিন্ন ধরনে চারবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর প্রথমবারের তুলনায় পরেরবার আক্রান্ত হলে শরীরে জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং মৃত্যুঝঁকি থাকে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরিন জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নমুনা সংগ্রহের পর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ডেন-২ শনাক্ত হয়েছে। ৩৮ শতাংশে রয়েছে ডেন-৩। ২০২২ সালে নমুনা পরীক্ষায় ৯০ শতাংশে ছিল ডেন-২।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এটি ডেঙ্গুর পরিবর্তিত রূপ। এর ফলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ায় শারীরিক জটিলতা বাড়ছে এবং ডেঙ্গুজ্বরের তীব্রতা অনেক বেশি।
এজন্য মশা যেন না কামড়ায় সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন অবশ্য বলেন, চলতি বছর ডেন-২ ধরনে আক্রান্ত হলে এবং দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে জটিলতা বাড়তে পারে।
জ্বর হলেই অবহেলা করা যাবে না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে হবে। কারণ শক সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। চলতি বছর শক সিনড্রোম বেশি হচ্ছে। এ কারণে অবহেলা করা যাবে না বলে জানিয়েছেন বিএসএমএমইউ-এর মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, শক সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির কিডনি, লিভার, ফুসফুস ও হার্ট দ্রুত অকার্যকরও হয়ে পড়ে। ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশা শরীরে কামড় দেওয়ার পর রক্তের মনোসাইটে অনিয়ন্ত্রিতভাবে জীবাণু বংশবিস্তার করে। প্রবহমান রক্তের মাধ্যমে জীবাণু হার্ট, লাং, লিভার ও কিডনিতে প্রবেশ করে অধিক হারে বংশবিস্তার করে এসব গুরুত্বপূর্ণ কোষের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোষঝিল্লিতে আক্রমণ করে প্রদাহের সৃষ্টি করে। কিডনির মূত্র উৎপাদনের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং লিভার অকার্যকর হয়।
করণীয় কী
ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই। কারণ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের বিশেষ কোনো ওষুধ নেই। এ কারণে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধন করতে হবে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। মশার ওপর দীর্ঘদিন গবেষণা করা এই কিটতত্ত্ববিদ বলেন, এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গুর জীবাণু মানুষের শরীরে ছড়ায়। আর এডিস সাধারণত আশপাশে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে হয়ে থাকে। এজন্য পানির পাত্র, ফুল বা গাছের টব, চৌবাচ্চা, ছাদে পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবে না। এসব পরিষ্কার রাখতে হবে। এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধে মানুষের পার্টিসিপেশনটা খুব জরুরি।
ডেঙ্গুর প্রকোপে ঢাকা শহর পুরোটাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, এই মুহূর্তে চিরুনি অভিযান চালানো ছাড়া বিকল্প নেই। ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি ব্লকে ভাগ করে সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মী এবং স্থানীয় যুবক-তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে এই অভিযানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বোঝাতে হবে, পানি জমে থাকে এমন পাত্র উল্টে রাখতে হবে। কারণ এডিস মশা জন্ম নেয় জমে থাকা পানিতে। পাশাপাশি উড়ন্ত মশাগুলোকে মারার জন্য কীটনাশকের ফগিং করতে হবে।