ছবি সংগৃহীত

৪৮ ঘন্টা নয় সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের দুই বছর পূর্ণ

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৩:৫৩
আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৩:৫৩

আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকান্ডের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। দুই বছর পার হয়ে গেলেও হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে প্রশাসনের ব্যর্থতায় লজ্জিত বলে জানিয়েছেন খোদ সরকারের তথ্যমন্ত্রী। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এই হত্যাকাণ্ডের পরই তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে। সময় গড়িয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বদল হয়েছে। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এসেই এই হত্যার রহস্য জানানোর দিনক্ষণ ঘোষণা করেন। তারপর সরকার বদল হয়। নতুন প্রতিমন্ত্রী পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তিনিও শোনালেন আশার কথা। প্রথমে এ মামলা তদন্ত করেছিল পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। তারা ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে হাইকোর্টে গিয়ে তদন্ত থেকে অব্যাহতি চায়। এরপর আদালতের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব নেয় র‌্যাব। র‌্যাব আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যর্থতা স্বীকার না করলেও তদন্ত কার্যত থেমে আছে। তদন্তে কোনো সুরাহা না হওয়ায় প্রকৃত অপরাধীরাও ধরা পড়েনি। নিহত সাংবাদিক দম্পতির পরিবার আর আশাবাদী হতে পারছে না। ক্ষুব্ধ তারা। হতাশ সাগর-রুনির সহকর্মীরা, গণমাধ্যমের কর্মীরা।

খুন হলেন সাগর-রুনি
যেদিন খুন হলেন সাগর-রুনি: শুক্রবার রাতের কোনো একসময় সাগর-রুনি দম্পতি খুন হন। ১১ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকালে মা-বাবার মৃত্যুর খবরটি নানিকে ফোন করে জানায় এই দম্পতির পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে মাহীন সরওয়ার মেঘ। মেহেরুন রুনির মা নুরুন নাহার মির্জা খুন হবার পরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মেঘ আজ সকাল সাতটার দিকে আমাকে ফোন করে। বলে, বাবা-মা মরে গেছে।’ এ খবর শুনে তিনি তাঁদের পশ্চিম রাজাবাজারের ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে মেয়ের বাসায় যান। শোয়ার ঘরে মেয়ে ও মেয়ের স্বামীর রক্তাক্ত লাশ দেখতে পেয়ে তিনি অন্যদের খবর দেন। খুন হওয়ার পর পরই পুলিশের বক্তব্য: সাগর-রুনি দম্পতি একমাত্র ছেলে মেঘকে নিয়ে পশ্চিম রাজাবাজারে ছয় তলা ভবনের পাঁচ তলায় থাকতেন। মেঘ গতকাল স্কুলের পিকনিক থেকে ফিরে ক্লান্ত থাকায় আগেই নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে মা-বাবার শোয়ার ঘরে গিয়ে তাঁদের রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে নানিকে খবর দেয়। ব্যর্থ ডিবি, হাল ছেড়েছে র‌্যাবও: এ মামলার তদন্ত শুরু করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ৬২ দিনের মাথায় (২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল) হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালতের নির্দেশে তদন্তভার নেয় র‌্যাব। তারা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে তোলে। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত দম্পতির শিশুপুত্র মাহীর সরওয়ারকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে। সাগরের কর্মস্থল মাছরাঙা টেলিভিশন আর রুনির কর্মস্থল এটিএন বাংলার কার্যালয়ে গিয়েও খোঁজাখুঁজি হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে শতাধিক ব্যক্তিকে। ২০১২ সালের মাঝামাঝি থেকে র‌্যাব বলা শুরু করে, নিরাপত্তাকর্মী এনামুল গ্রেপ্তার হলেই সব রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। এনামুলকে ধরতে ১০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি এনামুল গ্রেপ্তার হলেও তাঁর কাছ থেকে কোনো তথ্যই মেলেনি বলে র‌্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বস্তুত, এর পর থেকেই র‌্যাবের আর কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। র‌্যাব এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যর্থতা স্বীকার না করলেও হাল ছেড়ে দিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বিচার চাইতে মানববন্ধনে মেঘ
র‌্যাব ও ডিবির তিনজন কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি লাশ উদ্ধারের পরপরই সাগর-রুনির মুঠোফোনের কল তালিকার সূত্র ধরে ডিবির তদন্তকারী দলটি একজনকে সম্ভাব্য খুনি হিসেবে সন্দেহ করে। এরপর তারা তাদের সেই সন্দেহকে পোক্ত করতে কাজ করেছে এবং ভেবেছে, তারা মামলার প্রায় সুরাহা করে ফেলেছে। পরে দেখা গেছে, তাদের ওই সন্দেহই ভুল। এই ভুল সন্দেহের পেছনে ছুটতে গিয়ে সম্ভাব্য অন্য সূত্রগুলো আর খতিয়ে দেখা হয়নি। কর্মকর্তারা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও শুরু থেকে ওই ভুল বার্তা দিয়ে গেছেন। এর ফলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়া তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ঘটনার দুই দিন পর ১৩ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, প্রথমে অতি আত্মবিশ্বাস থেকে কর্মকর্তারা তদন্তের সাধারণ কৌশলগুলোকেও গুরুত্ব দেননি। নিহতদের ভিসেরা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়নি, যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করায় হত্যাকাণ্ডস্থল থেকে ফরেনসিক-বায়োমেট্রিক আলামতও সংগ্রহ করা যায়নি। প্রথম সন্দেহ ব্যর্থ হচ্ছে দেখে হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পর কর্মকর্তারা চুরি বা ডাকাতি সন্দেহ করে তদন্ত শুরু করেন। ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণ করে সিআইডি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, আলামত অস্পষ্ট। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের আলামত নষ্টের দায়ে অভিযুক্ত করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলাটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় রাতের অন্ধকারে এবং এর কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী নেই। সাগর ও রুনি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হওয়ার কারণে ঘটনার পরপরই পুলিশ আসার আগেই সাংবাদিক ও সাধারণ জনগণ ঘট���াস্থলে পৌঁছে মামলার সব গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট করে দেয়।’ অযথা কারাবাস: সব মিলিয়ে এ মামলায় এখন পর্যন্ত মোট আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন- রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল এবং নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। এঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই গত বছরের আগস্টে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হন। কর্মকর্তারা জানান, এই আটজনের কারও বিরুদ্ধে সাগর-রুনি হত্যায় জড়িত থাকার ন্যূনতম প্রমাণও মেলেনি। কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেননি। এঁদের পাঁচজন নিতাই হত্যা মামলার আসামি হলেও পলাশ ও তানভীর ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কারাভোগ করছেন সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই।
বাবা-মা'র কবরের পাশে মেঘ
পরিবার ক্ষুব্ধ: সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির গণমাধ্যমে বলেন, ‘সরকারের ৪৮ ঘণ্টা দুই বছরেও শেষ হলো না। সরকার আশাবাদী, কিন্তু আমি হতাশ। সরকার এ রহস্য উদ্ঘাটনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তাদের উচিত ব্যর্থতার কথা জনসম্মুখে স্বীকার করা।’ রুনির মা নুরুন নাহার মির্জা কথা বলার পর্যায়ে নেই। রুনির ভাই নওশের আলম বললেন, ‘মা খুব অসুস্থ। আমাদের পরিবারের একটাই দাবি, হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দেখা।’