ছবি সংগৃহীত

হাইকমিশনে বসে পাকিস্তানি কর্মকর্তার এত অপকর্ম!

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ০৭:৩৩
আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ০৭:৩৩

(প্রিয়.কম) ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা এ দেশে জঙ্গি সংগঠনের অর্থায়ন, মুদ্রাপাচার, জাল মুদ্রা সরবরাহসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। মোহাম্মদ মাযহার খান নামের এই কর্মকর্তাকে পুলিশ গত মাসে হাতেনাতে আটক করলেও পরে হাইকমিশনের তৎপরতায় বনানী থানা থেকে মুক্ত হন তিনি। গোয়েন্দা অনুসন্ধানেও পাকিস্তান হাইকমিশনের এই সহকারী ভিসা কর্মকর্তার জঙ্গি কানেকশনের পাশাপাশি নানা অপতৎপরতার তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। সে সুবাদে দ্রুত সময়ের মধ্যে মাযহার খানকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি এ দেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানি নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জোর সুপারিশ করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। হাইকমিশন কর্মকর্তাদের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ যাচাই করা জটিল। এমনকি জিজ্ঞাসাবাদ করাটাই সম্ভব হয় না সে দেশের কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপের কারণে। সর্বশেষ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি উল্লেখ করে গত মাসে সরকারকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার বনানীর মৈত্রী মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় মোহাম্মদ মাযহার খান ও মজিবুর রহমান নামের দুজনকে। আটক হওয়ার মুহূর্তে মাযহার কিছু কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন। সেগুলো পরে জোড়া দিয়ে পুলিশ দেখতে পায়, তাতে বেশ কিছু বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর ও নাম রয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই শেষ হওয়ার আগেই রাতে পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রথম সচিব সামিনা মাহতাব বনানী থানায় উপস্থিত হয়ে মাযহার খানকে নিজ হেফাজতে নিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে গোয়েন্দারা অনুসন্ধানে জানতে পারেন, মাযহার খানের হেফাজত থেকে উদ্ধার করা ছেঁড়া কাগজে যেসব পাসপোর্ট নম্বর ছিল এর মধ্যে তিনজন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্‌রীরের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আটক মজিবুর রহমান জিজ্ঞাসাবাদে জানান, দূতাবাসে একই পদের আগের কর্মকর্তার মাধ্যমে মাযহার খানের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। গত এক দশকে মজিবুর ২২ বার পাকিস্তান, ১১ বার ভারত ও ২২ বার থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন। সর্বশেষ মাযহার এক লাখ ৮০ হাজার ভারতীয় জাল রুপি মজিবুরকে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। জাহিদ, ইমরানসহ আরো কয়েকজনকে মাযহার এ জাল রুপির ব্যবসায় ব্যবহার করেছেন বলে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে মজিবুর উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার ধ্বংস করতে এই পাকিস্তানি কর্মকর্তার ভূমিকা রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের অভিমত। অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে মাযহারের যোগাযোগ রয়েছে বলে তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানিয়েছে, ১৫ জানুয়ারি পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ ইমরানকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগ আটক করে। তাঁর কাছে পাওয়া যায় ৮০ লাখ ভারতীয় রুপি। ইমরান জাল পাসপোর্ট ও ভিসার মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢুকেছেন বলেও তথ্য মেলে। এ ধরনের মুদ্রাপাচার ও জালিয়াতি ছাড়াও পাকিস্তান হাইকমিশনের কতিপয় কর্মকর্তা হিযবুত তাহ্‌রীর ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন বলে তথ্য রয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন সময় জঙ্গি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি রহস্যময় কর্মকাণ্ডে যুক্ত। বেশ কয়েকজন জাল ভারতীয় রুপির ব্যবসায় যুক্ত বলেও তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। বিশেষ করে ভিসা কর্মকর্তা মাযহার দুই বছর ধরে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ অর্থায়ন করে আসছেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী এ কর্মকর্তা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কূটনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে তিনি নাশকতাসহ নানা পরিকল্পনায় যুক্ত বলেও তথ্য রয়েছে। আলোচিত মাযহার খানকে বহিষ্কারের জন্য ইতিমধ্যে সুপারিশ করা হয়েছে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। পাকিস্তান থেকে আগতদের ব্যাপারে কড়া নজরদারির জন্যও বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। পাকিস্তানি নাগরিক ও হাইকমিশন কর্মকর্তাদের ভূমিকা প্রসঙ্গে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের অনেকে জানিয়েছেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশে জেএমবিসহ কয়েকটি সংগঠন যে জঙ্গি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল, তাতে পাকিস্তানের কিছু নাগরিকের সহায়তার তথ্য মিলেছিল। কূটনৈতিক সম্পর্কের স্বার্থে এ বিষয়ে তদন্ত বেশিদূর এগোয়নি। পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত অনেকের মাধ্যমে জঙ্গিদের অর্থায়নসহ নানা কর্মকাণ্ডে সহায়তা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আর ভারতীয় মুদ্রা জালিয়াতিতে পাকিস্তানি চক্র জড়িত রয়েছে বলে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে অসংখ্যবার। এ চক্র বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এসব অপকর্মে সর্বশেষ হাইকমিশন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য উদ্বেগজনক। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, পাকিস্তানের কাশ্মীরভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার শীর্ষ নেতা শাকিল মোহাম্মদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে জাল মুদ্রার ব্যবসা চলছে। ওই গডফাদারের সহকারী হিসেবে ৫০ জন সদস্যের দেশি-বিদেশি শক্তিশালী জঙ্গি গ্রুপ বাংলাদেশে সক্রিয় রয়েছে। লস্কর-ই-তৈয়বার এ দেশীয় আরো এক এজেন্টকে গ্রেপ্তার করে এ তথ্য জেনেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাঁর নাম মো. আলাউদ্দিন। বরিশালের উজিরপুর থেকে আলাউদ্দিনকে গ্রেপ্তারের আগে গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েছিলেন প্রফেসর সেলিম নামের এক ব্যক্তি। গত বছর শুধু লস্কর-ই-তৈয়বারই ১২ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন ছিল পকিস্তানের নাগরিক। অন্যরা লস্কর-ই-তৈয়বার এ দেশীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিল। তাদের কাছ থেকে দেশি-বিদেশি প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যমানের জাল মুদ্রা আটক করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই গ্রেপ্তারের পর জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও একই কাজে জড়িয়ে পড়েছে বলে গোয়েন্দা পুলিশ দাবি করেছে। এদিকে পাকিস্তানে বসবাসরত আল-কায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইজাজ আহমদের সমর্থনে আনসারুল্লাহর কর্মকাণ্ড এগিয়ে চলছে। আনসারুল্লাহর সব নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত আসছে পাকিস্তান থেকে। এর পাশাপাশি জেমএমবির সাবেক আমির সাইদুরের মেয়ে নাসরিন আখতার ও তাঁর স্বামী জাভেদ আখতার পাকিস্তানের করাচি থেকে জেএমবির কার্যক্রম কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করছেন। গত বছর ১৮ জানুয়ারি মালিবাগের মৌবন হোটেল থেকে পাকিস্তানি নাগরিক মো. দানিশ, সাব্বির ও বাংলাদেশি নাগরিক ফাতেমা আক্তার অপিকে ১০ লাখ ভারতীয় জাল রুপিসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এর তিন দিন পর ৫০ হাজার ভারতীয় জাল রুপিসহ গ্রেপ্তার করা হয় জাহিদ হাসান নামের এক বাংলাদেশিকে। ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ৯০ হাজার সৌদি রিয়ালসহ গ্রেপ্তার করা হয় সুমন নামের জাল মুদ্রা ব্যবসায়ীকে। ১০ ফেব্রুয়ারি ১০ হাজার টাকার ভারতীয় জাল রুপিসহ গুলিস্তান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আব্দুল মান্নান হাওলাদারকে। ১৫ মার্চ যাত্রাবাড়ীর বৌবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল মুদ্রাচক্রের সক্রিয় সদস্য রহিম ওরফে বাদশা, মেহেদী হাসান ওরফে বাবু ও রাবেয়া আক্তার সাথীকে তিন লাখ জাল টাকা ও ৫৪ হাজার ভারতীয় জাল রুপিসহ জাল মুদ্রা তৈরির ডাইস ও কম্পিটার আটক করা হয়। এদের মধ্যে পাকিস্তানের নাগরিক মো. দানিশ জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছেন বলে পুলিশ জানায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, পাকিস্তানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গ্রুপের সক্রিয় সদস্য আব্বাস, ইউনুস ও মোনায়েম মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে আসে। আর তাদের সহায়তা করছেন পাকিস্তান হাইকমিশনের কিছু কর্মকর্তা। তাদের এ দেশীয় এজেন্টসহ বেশ কিছু পাকিস্তানি নাগরিককে ইতিমধ্যে নজরদারিতে আনা হয়েছে। সৌজন্যে:কালেরকণ্ঠ