'বেদের মেয়ে জোছনা' সিনেমাটা দেখেছেন? বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে এই সিনেমাটি মাইলফলক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। একটা সময় ছিল, যখন সাপের গল্প নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। সাপের গল্প মানেই সেখানে অবধারিতভাব উপস্থিত থাকবে বেদে। তবে সিনেমায় যেভাবে দেখা যায়, বেদেজীবন অতটা রঙিন নয়!
বেদের আদি :
ভারতীয় উপমহাদেশের এক অতি পরিচিত যাযাবর জনগোষ্ঠী হলো বেদে। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে তারা বাদিয়া, বেদিয়া, বাইদিয়া, বেদে, বেদেনী, বাইদ্যা, বাইদ্যানী, সাপুড়ে, সাপুড়িয়া ইত্যাদি নামে পরিচিত। বেদেদের আদি নাম মনতং। জানা যায় যে, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানরাজ বল্লার রাজার সাথে তারা প্রথম ঢাকায় আসে। প্রথমে তারা বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। তারপর সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আসামেও ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে নদীবহুল অঞ্চলে বেদে সম্প্রদায় বসবাস করে। নদী-নালার আশেপাশের ভূমিতে মাচা তৈরি করে অথবা নৌকায় বাস করে তারা।

যাযাবর বেদেরা এক জায়গায় দীর্ঘদিন থাকে না। জলপথে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায় জীবিকার সন্ধানে। জলপথে চলাচল বলেই নৌকা তাদের কাছে খুবই মূল্যবান! তবে খুব বেশি বড় হয় না নৌকাগুলো। এই নৌকাতেই হয় রান্না-বাড়া, খাওয়া-দাওয়া আর থাকা। এক একটি নৌকাতে থাকে এক একটি পরিবার।
নানা পেশার বেদে :
বেদে নামটির অবজ্ঞাসূচক 'বাইদ্যা' (হাতুড়ে ডাক্তার), 'বৈদ্য' (চিকিত্সক) থেকে উদ্ভূত বলে গবেষকরা মনে করেন। অধিকাংশ বেদেই চিকিত্সার সাথে জড়িত বলে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে পরিচিত হয়। আগে বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা সাপে কাটা রোগীর চিকিত্সা করত। বর্তমানেও কিছু কিছু অঞ্চলে তারা এ চিকিত্সা করে। অঞ্চলভেদে এদেরকে 'ওঝা' বা 'বিষবৈদ্য'ও বলা হয়ে থাকে। তবে বেদেরা যে শুধু সাপ ধরে বা সাপের খেলা দেখায় তা নয়, তাদের পেশাতেও রয়েছে বহু বৈচিত্র্য! যেমন মালবৈদ্য। এরা দাঁতের পোকা বের করে এবং সাপের খেলা দেখায়। সাপের বাক্স আর তুবড়ি বাঁশি নিয়ে এরা প্রতিদিন চলে যায় দূর-দূরান্তে।
আরেকদল আছে বাজিকর। এদেরকে 'মাল'ও বলা হয়ে থাকে। তাবিজ-কবজ দেয়া ও নানারকম ভেল্কি দেখিয়ে রোজগার করে তারা। বাঁদরের খেলা, সাপ-নেউলের খেলা শহরে-বন্দরে প্রায়ই চোখে পড়ে। যারা এসব খেলা দেখায় তারাই বাজিকর হিসেবে পরিচিত।
.jpg)
বেদেদের মধ্যে রয়েছে কুড়িন্দা। এরা হাতের রেখা দেখে ভাগ্য বলে দেয়। কুড়িন্দাদের মধ্যে অনেকে হারিয়ে যাওয়া সোনা-রূপার গয়না কুড়িয়ে দেয় পুকুর থেকে। যেসব কুড়িন্দা হাতের রেখা দেখে ভাগ্য বলে দেয়, তারাও বিভিন্ন তাবিজ-কবজ দিয়ে থাকে। সাপের জন্য তারা তাবিজ দেয় সাদা লজ্জাবতীর। তাদের বিশ্বাস, এ তাবিজ সঙ্গে রাখলে সাপ-খোপ ধারেকাছে আসে না! এছাড়া তাদের কাছে থাকে বিভিন্ন ধরনের পুস্তিকা। যেমন 'জয় জয় জাগ্রত মনসা', 'লতাপাতার গুণ', 'কামিক্ষে তন্ত্রসার', 'মন্ত্র বিদ্যা শক্তি' ইত্যাদি।
বেদেদের আরেকটি পেশা গাইন। যারা ঝিনুক কুড়িয়ে মুক্তা খুঁজত তাদের গাইন বলা হতো। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ঝিনুকের সংখ্যা এখন একেবারেই নগন্য। তাই গাইন পেশায় কেউ নেই এখন। তবে আছে চাপালি ও লইয়া। চাপালিরা গ্রামে গ্রামে ঝাঁকায় করে প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি করে এবং লইয়ারা খালে-বিলে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে।
বেদেদের একটি উপগোষ্ঠী বা গোত্র হচ্ছে সান্দার। সান্দার নারীরা ধামা ও ঝাঁকায় করে গ্রামে গ্রামে চুড়ি, কাচ ও মেলামাইনের তৈজসপত্র বিক্রি করে থাকে। পুরুষদের কেউ কেউ নদীতে মাছ ধরে, কেউবা নকল তালা-চাবির তৈরির কাজ করে।
বেদে নারীদের বিভিন্ন শহরে দলবদ্ধভাবে ঘুরতে দেখা যায়। সাথে থাকে সাপের ঝাঁপি ও ওষুধের ঝুলি। কেউ কেউ সাপের ছোট বাক্স হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। হঠাত্ করে সাপ বের করে পথচারীদের সামনে ধরে রাখে। তাতে ভয় পেয়ে অনেকেই টাকা দেন। বেদেনীদের অনেকে শরীরে উল্কি এঁকে আয় করে। আবার অনেকে আছে যারা দেহ বিকিয়ে আয় করে।
ধর্ম ও সংস্কৃতি :
বেদেরা সাধারণত ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তবে ধর্মের ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো গোঁড়ামি দেখা যায় না। তবে মুসলমানরা তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখে। কারণ জাতি হিসেবে তারা তথাকথিত নিম্নবর্গ।
বেদেদের পিতৃপ্রধান সমাজ হলেও মেয়েরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বেদে পুরুষরা কিছুটা অলস প্রকৃতির। সব রকমের কঠোর পরিশ্রম নারীরা করে থাকে।
বেদেদের রয়েছে বিভিন্ন গোত্র। আগে তাদের বৈবাহিক রীতি ছিল গোত্রে গোত্রে। কোনো কোনো জায়গায় এখনো এই ঐতিহ্য বজায় থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিথিল হয়ে পড়েছে।
প্রযুক্তির এই চরম উত্কর্ষের সময়ে ক্রমশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে বন-বাদাড়। সাপ, ঝিনুক, বানর, নেউল এখন আর সহজে পাওয়া যায় না। তাই শত চেষ্টা করেও বেদেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশায় টিকে থাকতে পারছে না। বদলাতে বাধ্য হচ্ছে জীবিকার মাধ্যম। ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হতে চলেছে বেদে সম্প্রদায়।