
ছবি সংগৃহীত
গোয়েন্দাদের হাতের মুঠোয় টেলিযোগাযোগ সেক্টর
আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ১২:৩০
(প্রিয়.কম) ভাইবার, ট্যাঙ্গো, লাইন, স্কাইপেসহ মোবাইল ফোনের বৈধ-অবৈধ কোনো অ্যাপসই আর নির্ঝঞ্ঝাট, নিরুপদ্রব নেই। ইন্টারনেট ফোন ছাড়াও রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোবাইল ফোন গ্রাহকদের কথোপকথনও রেকর্ড করা হচ্ছে নিয়মিতভাবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পুরো টেলিকম সেক্টরই এখন গোয়েন্দাদের হাতের মুঠোয়। এতদিন ধারণা ছিল শুধু টিএন্ডটি, মোবাইল ফোন ও তারবিহীন পিএসটিএন গ্রাহকের কথোপকথন, ভয়েস ও ডাটা রেকর্ড করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ইন্টারনেট ফোনের কথোপকথনও সহজেই রেকর্ড করে নিচ্ছে গোয়েন্দারা। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার ভাইবারে কথোপকথন ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। দৈনিক যুগান্তরের বিশেষ প্রতিবেদনে মুজিব মাসুদ এমনটাই জানিয়েছেন। পত্রিকাটি জানিয়েছে, সরকারের হাতে এমন কিছু শক্তিশালী প্রযুক্তি আছে যা দিয়েই সব ধরনের ফোনকলেই আড়িপাতা ও রেকর্ড করা সম্ভব। একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে থাকা এক ধরনের সফটওয়্যার দিয়ে মান্নার মোবাইল ফোন থেকে ভাইবারের ওই কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছিল। মান্নার টেলিফোনের আইপি (ইন্টারনেট ফোন) কোড নম্বর ট্র্যাক করে এই কথোপকথন রেকর্ড করা হয়। ২০১২ সালে ইন্টারনেট ফোনে নজরদারি করতে পারে এমন কয়েকটি সফটওয়্যার ক্রয় করে সরকার। ইউরোপীয় একটি কোম্পানির কাছ থেকেই এই সফটওয়্যারগুলো কেনা হয়। ব্যক্তিগত কম্পিউটারের অডিও, ভিডিও ও লিখিত কোনো ডকুমেন্ট দূরবর্তী অবস্থান থেকে নজরদারি করার জন্য ফিনস্পাই নামে এই সফটওয়্যারের লাইসেন্স কেনে সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ফিনস্পাই কম্পিউটারে একবার যুক্ত করার পর এটি অন্য একটি কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে ইন্টারনেটের যে কোনো অ্যাপসের মাধ্যমে কথোপকথনও রেকর্ড করা যায়। আড়িপাতা ছাড়াও এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং, ই-মেইল এবং লুকানো ফাইলও উদ্ধার করা সম্ভব। ব্যবহারকারীর পাসওয়ার্ড দিয়ে হারিয়ে যাওয়া কিংবা ডিলিট করে দেয়া ডকুমেন্টও ফিনস্পাই সফটওয়্যার দিয়ে বের করা যায়। ২০১৩ সালে র্যাব আইএমএসআই ক্যাচার নামে একটি প্রযুক্তি কেনে। এটি গাড়িতে ব্যবহারযোগ্য শক্তিশালী একটি যন্ত্র। এর মাধ্যমেও ইন্টারনেট ফোনের কথোপকথন রেকর্ড করা সম্ভব। এই গাড়িটি একটি নির্দিষ্ট বাসা কিংবা এলাকায় রাখলে ওই এলাকার সব ধরনের ফোনের কথোপকথন রেকর্ড হয়ে যায়। জানা গেছে, সরকারের ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টারের (এনএমসি) মাধ্যমে র্যাব এই নজরদারি করে। এর মাধ্যমে একবারে ২০ হাজার মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট কল রেকর্ড করা যায়। সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রাথমিকভাবে তালিকাভুক্ত রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সন্দেহভাজনদের ভাইবারসহ আইপি ফোনগুলোতে আড়ি পাতছে সরকার। অন্যদিকে বিটিআরসির একটি সূত্র জানায়, আইসিএক্সের মাধ্যমে যেসব গ্রাহক ভাইবার কিংবা অন্য কোনো ইন্টারনেট অ্যাপসে কথা বলছেন বা এসএমএস পাঠাচ্ছেন তার সবগুলোই বর্তমানে রেকর্ড করা হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৪ কোটি ২৭ লাখ ইন্টারনেট ফোন রেকর্ড হচ্ছে আইসিএক্স সার্ভারে। জানা গেছে, শিগগিরই বাধ্যতামূলকভাবে এই সফটওয়্যার সমৃদ্ধ মেশিন বসাতে টিএন্ডটিসহ সব মোবাইল ফোন অপারেটরকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এতে যে টাকা খরচ হবে তার অর্ধেক মোবাইল ফোন অপারেটর, বাকিটা সরকার পরিশোধ করবে। জানা গেছে, জার্মানির একটি কোম্পানির কাছ থেকে এই প্রযুক্তিগত সহায়তা নেয়া হবে। মোবাইল ফোন নজরদারির এই উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে একসঙ্গে ১২ কোটি ফোনকল, ভাইবার, ট্যাঙ্গো, স্কাইপে, লাইন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আসা তথ্য ও কথোপকথনের ওপর নজরদারি সম্ভব হবে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব (অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর্স বাংলাদেশ) সূত্রে জানা গেছে, ৬টি মোবাইল ফোন কোম্পানি এরই মধ্যে এই শক্তিশালী প্রযুক্তি ক্রয়ে ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়েছে সরকারকে। অ্যামটবের প্রধান নির্বাহী নুরুল কবির যুগান্তরকে জানান, লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী মোবাইল ফোন অপারেটরদের এই অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সব মোবাইল অপারেটর এই যন্ত্র বসালে কারও টেলিফোনই আড়িপাতা থেকে বাদ যাবে না। মোবাইল ফোন অপারেটররা বর্তমানে তাদের ইন্টারনেট ফোন গ্রাহক বাদে বাকি সব গ্রাহকের ফোনালাপ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রেকর্ড করছে। তবে কেবল রাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তা, ষড়যন্ত্র, সরকার উৎখাতের বিষয়ে কথোপকথন, জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা, জঙ্গি অর্থায়ন, বোমা কিংবা পেট্রলবোমা হামলা সংক্রান্ত কোনো কথাবার্তা না থাকলে কোনো ফোনালাপই একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সংরক্ষণ করা হয় না। চলতি মাসেই মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মোবাইল ফোন কথোপকথনের কিছু রেকর্ড উপস্থাপন করা হয়। তাতে দেখা গেছে, ওইসব কথোপকথনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে আন্দোলন সংক্রান্ত কিছু স্পর্শকাতর নির্দেশনা রয়েছে নেতাকর্মীদের প্রতি। ওই বৈঠকের পরই মোবাইল ফোনে ভাইবার, ট্যাঙ্গো, লাইনসহ ইন্টারনেট ফোনগুলো নজরদারির ব্যবস্থা আরও উন্নত করার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, সরকারের হাতে এখন এমন প্রযুক্তি আছে যা দিয়ে ভাইবার, ট্যাঙ্গো, লাইনসহ বিভিন্ন অ্যাপসের কথা ও ডাটা রেকর্ড করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিমকার্ডের ভয়েস কল ও ডাটাও রেকর্ড করা সম্ভব। কাজেই রাস্তার মোড় থেকে রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিমকার্ড কিনে ঝুঁকিপূর্ণ কথা বলে কিংবা এসএমএস করেই ষড়যন্ত্র করে এখন কেউ পার পাবে না। যে কোনো মুহূর্তে ওই গ্রাহককে তারা শনাক্ত করতে পারবে। একই সঙ্গে ওই সিমকার্ডের ভয়েস ও ডাটা পর্যন্ত বের করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, বিটিআরসি সম্প্রতি ইন্টারনেট সেফটি সলিউশন ইন বাংলাদেশ (আইএসএন) নামে একটি প্রযুক্তি সংযোজন করেছে। বিদেশী বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে বিটিআরসির একটি বিশেষজ্ঞ টিম এই প্রযুক্তটি ব্যবহার করছে। মূলত এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ফোনের (আইপি) মাধ্যমে গ্রাহকরা যেসব অ্যাপস ব্যবহার করছেন সেগুলোতে আড়িপাতা এবং কল ও এসএমএস রেকর্ড করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বুধবার জানান, দেশের ৬টি মোবাইল ফোন অপারেটরসহ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) কোম্পানিগুলোই গ্রাহকদের ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে গ্রাহকরা কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও স্মার্টফোনের মাধ্যমে সহজে ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে ভাইবারসহ অন্য অ্যাপসগুলো ব্যবহার করতে পারছেন। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, কোনো গ্রাহক ইন্টারনেট সেবা নেয়ার পর সার্ভিস প্রোভাইডার সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের নামে একটি গোপন আইপি নম্বর খোলে। মূলত গ্রাহকের ইন্টারনেটে কোনো সমস্যা দেখা দিলে ওই সার্ভিস প্রোভাইডার এই আইপি নম্বর দিয়ে গ্রাহকের ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে পারে। জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আইএসপি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আইপি নম্বর সংগ্রহ করে তার মাধ্যমে ভাইবারসহ অন্য অ্যাপসগুলোর ওপর নজরদারি করছে। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি ২৭ লাখ। এর মধ্যে শুধু মোবাইল ফোন অপারেটরদের গ্রাহকই ৪ কোটি। বাকি গ্রাহকরা ওয়াইম্যাক্স, আইএসপি ও পিএসটিএন অপারেটরদের। এদিকে ভাইবারসহ ইন্টারনেট ফোন ছাড়াও সরকারের নির্দেশে ৬টি মুঠোফোন অপারেটর, বিটিসিএল ও ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জগুলো (আইসিএএক্স) বাধ্যতামূলকভাবে সব গ্রাহকের ফোনালাপ রেকর্ড করছে। আন্তর্জাতিক কলের আদান-প্রদান রেকর্ড করছে আইসিএক্স। অভ্যন্তরীণ কলগুলো রেকর্ড করছে সংশ্লিষ্ট অপারেটর। সূত্র জানায়, ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়েগুলো (আইজিডব্লিউ) বিদেশ থেকে যেসব শ্রেণীর কল আনা-নেয়া করছে সেগুলো বিটিসিএলসহ ২৬টি আইসিএক্স অপারেটরের মাধ্যমে বিভিন্ন অপারেটরের কাছে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে টেলিফোনের দুই প্রান্তের গ্রাহকের মধ্যে কি কথোপকথন বা তথ্য বিনিময় হচ্ছে তা ধারণ হয়ে যাচ্ছে আইসিএক্স সার্ভারে। মোবাইল ফোন অপরারেট কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, সরকারের নির্দেশে প্রত্যেকটি অপারেটর এরই মধ্যে তাদের গ্রাহকদের ভয়েস ও ডাটা রেকর্ডের জন্য বিশেষজ্ঞ টিমের নেতৃত্বে একটি নতুন বিভাগ খুলেছে। ওই বিভাগ দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে। তারা প্রতিনিয়ত সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার চাহিদা পূরণ করছে। সরকার থেকে যখন কোনো গ্রাহকের নম্বর সম্পর্কে তথ্য ও অবস্থান জানতে চাওয়া হচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে তারা সেগুলো সরবরাহ করছে। বিটিআরসির একটি টিমও মোবাইল ফোন অপারেটর ও পিএসটিএন অপারেটরদের এই বিভাগটির কার্যক্রম মনিটর করছে। আড়িপাতা আইনে যা আছে : বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন আইন-২০০১ এ সরকারকে টেলিফোনে আড়িপাতার ক্ষমতা দেয়া আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃংখলার স্বার্থে এ আইনের ৯৭ক ধারায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে, এই আইন বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃংখলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দিতে পারবে এবং এ কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারবে এবং পরিচালনাকারী ওই নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে। ২০০৬ সালে এ ধারায় সংশোধনী এনে আরও বলা হয়েছে, তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৯৭ক-এর অধীন সরকার থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ সরকার আইনশৃংখলা বাহিনীর যে সংস্থা বা যে কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেবে সে সংস্থা বা ব্যক্তি টেলিফোনে আড়িপাততে পারবেন। দৈনিক যুগান্তরের সৌজন্যে।