
দখলের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সাথে সাথে নষ্ট হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও। ছবি: খন্দকার মহিউদ্দিন
বিশ্ব জলাভূমি দিবস: বিপন্ন টাঙ্গুয়ার হাওর
আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৮:৫২
(প্রিয়.কম) স্থানীয়দের কাছে ‘নয় কুড়ি বিল আর তের কুড়ি কান্দা’ নামেই পরিচিত বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওর। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর জীববৈচিত্র্যের আধার টাঙ্গুয়ার হাওরকে ২০০০ সালে দ্বিতীয় রামসার সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি মেলায় হাওরটির গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকারও যেন নড়েচড়ে বসে। দ্রুততম সময়ে হাওরটি দেখভালের দায়িত্ব ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও হাওরটির প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখা। কিন্তু সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীনতা, বন ধ্বংস, অবাধে পাখি ও মাছ শিকার এমনকি হাওর ভরাটের মতো ঘটনায় সরকারি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ধারে কাছেও নেই। ফলে সীমাহীন ঐশ্বর্যে ভরা হাওরটি বিপন্ন হতে বসেছে।
সুনামগঞ্জ জেলার সরকারি ওয়েবসাইটে ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে বলা হয়, ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেষে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলা জুড়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। প্রায় ২০ হাজার একরের এই হাওরে বোয়াল, গাং মাগুর, রুই, কালি বাউশ, কাতল, বাইম, তারা বাইম, গুলশা, গুতুম, আইড়, টেংরা, তিতনা, গজার, গরিয়া, বেতি, কাকিয়া, রুই ও কাল বাউশসহ প্রায় ১৪১ প্রজাতির মাছ; হিজল কড়চবাগ, জলাবন, কান্দা, নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলেঞ্চা, শতমূলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদি ২০৮ প্রজাতির উদ্ভিদ; কুট, মরিচা ভুতিহাঁস, বালিহাঁস, সরাইল, কাইম, পিয়ংহাস, সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, লেনজা, পানকৌড়ি ইত্যাদি ২০১ প্রজাতির উভচর পাখির বিচরণ রয়েছে।

হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ওয়াচ টাওয়ার। ছবি: খন্দকার মহিউদ্দিন
এছাড়া প্রায় ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ রয়েছে যা হারওরটির জীববৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাওরে প্রজনন মৌসুম না মেনে অবাধে মাছ শিকারে মাছ ধ্বংসের পথে। শুষ্ক মৌসুমে হাওর এলাকার পানি কমে এলে পানি সেচে মাছ শিকারও মৎস্য সম্পদ ধ্বংসের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া অতিলোভীদের নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যবহারও স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের ভবিষ্যতকে নষ্ট করে দিচ্ছে।
শীত মৌসুমে বিষটোপ ব্যবহারে পাখি শিকার ও বিক্রি পাখিদের প্রতি প্রকাশ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাওরে কখনও কখনও মরা পাখিও চোখে পড়ছে। কিন্তু মরা পাখিটি যদি বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে থাকে তবে তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। হাওর এলাকায় অবাধে টুরিস্ট প্রবেশ, ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে হাওরে অবাধ চলাচল, জলাভূমির গাছ সাবার, ভ্রমণকারীদের গান-বাজনা ইত্যাদিও হাওরের পরিবেশ নষ্ট করছে।
এ ছাড়া হাওর অঞ্চলে বিশেষ করে গোলাবাড়ি এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দিনের পর দিন অবৈধভাবে পিকনিক স্পট তৈরী করে, রাত্রিযাপনে তাঁবু ভাড়া দিয়ে চলেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে যা হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ।

শীতে আগমন ঘটে লাখ লাখ পাখির। ছবি: সংগৃহীত
এর আগে টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে একটি প্রকল্প পরিচালনা করেছিল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নিসর্গ (আইপ্যাক প্রকল্প)। ওই প্রকল্পের এক হিসেবে দেখানো হয়েছে, গত ১৩ বছরে এসব মাছ ও উদ্ভিদের অধিকাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বিস্ময়করভাবে কমে গেছে পাখির বিচরণ।
গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) কবির বিন আনোয়ার টাঙ্গুয়ার হাওর পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসন ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) প্রকল্পকে নানা দিক বিবেচনা করে ‘ব্যর্থ’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
এ বিষয়ে আইইউসিএন এর দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা প্রিয়.কমকে বলেন, ‘মূলত স্থানীয় জনগণের অজ্ঞতা এবং প্রভাবশালীদের লোভই টাঙ্গুয়ার হাওরকে বিপন্ন করে তুলেছে। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে সরকার ও আইইউসিএন যৌথভাবে স্থানীয় কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে প্রকল্প চালাচ্ছে, যা বেশ সফল হয়েছে বলেই ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রভাবশালীরা হাওর থেকে সরাসরি লাভবান হতো। ইজারা পদ্ধতি বাতিল করার মাধ্যমে হাওরটি বড় রকমের রক্ষা পেয়েছে। একইভাবে আইইউসিএন পরিচালিত প্রকল্পে জেলেসহ স্থানীয় সাধারণ মানুষকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। যারা মূলত অলিখিতভাবে হাওরের রক্ষাকর্তা এবং মালিক। ফলে সমাজভিত্তিক সংরক্ষণে স্থানীয়রা উৎসাহিত হয়েছে।’

হাওরের বুকে সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। ছবি: খন্দকার মহিউদ্দিন
ওই কর্মকর্তা পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘এটা ঠিক যে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল আইইউসিএন হয়তো আনতে পারিনি। শুধু একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এত স্বল্প সময়ে শতভাগ সফলতা কিভাবে সম্ভব? তবে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।’
হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও স্থানীয় জেলা প্রশাসনের দায় সম্পর্কে সুনামগঞ্জ জেলার সহকারী কমিশনার (টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনা ও তথ্য ও প্রযুক্তি শাখা) মনজুর আলম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘২০০০ সালে হাওরটি ‘রামসার সাইট’ এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ইজারা প্রথা বাতিল হয় এবং ২০০৩ সালে হাওরটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয় জেলা প্রশাসন। পরবর্তীতে হাওরটির জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০০৬ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং আইইউসিএন যৌথভাবে ‘সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ নামের একটি প্রকল্প শুরু করে। যাকে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিচ্ছে জেলা প্রশাসন। ওই প্রকল্পটির মাধ্যমে হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্থানীয় মানুষকে ব্যাপকমাত্রায় সচেতন করা সম্ভব হয়েছে।’
প্রভাবশালীদের কর্মকাণ্ডে হাওরের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অসাধু ব্যক্তিদের হাত থেকে হাওরটি রক্ষায় একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর মাধ্যমে হাওরটি পাহারা দেওয়া হয়। হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে জেলা প্রশাসন।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসককে বার বার ফোন করা হলেও ফোন রিসিভ হয়নি।
প্রিয় সংবাদ/আরএ