সিলেটে খাসিয়াদের একটি ঘর। ছবি: লেখক

সিলেটের খাসিয়া নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা

সব্যসাচী মিথুন
ফ্রিল্যান্স গণমাধ্যমকর্মী ও নিবন্ধ লেখক, সমাজ বিশ্লেষক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী
প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:৫৪
আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:৫৪

বাংলাদেশের প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি ও ধর্মীয় পুণ্যভূমি সিলেটে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বসবাস করেন বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ। এ জনপদে রয়েছে বহু ভাষা ও বৈচিত্র্যমণ্ডিত সাংস্কৃতিক আবহ।

তবে সিলেট জেলায় যে কয়টি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন, তার মধ্যে খাসিয়া সম্প্রদায় অন্যতম।

ভারতীয় উপমহাদেশে খাসিয়া একটি সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত, যাদের অধিকাংশই উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বাস করে। প্রতিবেশী আসাম ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশেও তাদের বসতি রয়েছে।

বাংলাদেশে খাসিয়াদের বসবাস মূলত সিলেটের জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও কুলাউড়া উপজেলায় এবং সুনামগঞ্জ জেলায় তাদের বসবাস রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, খাসিয়ারা বাংলাদেশের ৪৫টি জনজাতির একটি। এরা নৃতাত্ত্বিকভাবে মঙ্গোলীয় হলেও কম্বোডিয়ার ‘খেমার’ গোত্রভুক্ত। বর্তমানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আসল বৈশিষ্ট্য থেকে প্রায় বিচ্যুত খাসিয়া সম্প্রদায়।

ঐতিহ্যবাহী খাসিয়া পোশাক ধারা, সা, ফংয়ের পরিবর্তে তারা এখন প্যান্ট, শার্ট, কোর্টেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এসেছে খাদ্যতালিকাতেও পরিবর্তন। খাসিয়াদের নিজস্ব খাবার জাঙ, পমের পরিবর্তে এখন তারা নাস্তা করে চা-বিস্কুট দিয়ে।

আধুনিকতার স্রোত আর প্রযুক্তির জ্ঞানের প্রসারই এর কারণ বলে অনেকের ধারণা। আবার অনেকে মনে করেন, পুরোপুরি খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার ফলে তাদের জীবনে ইউরোপীয় জীবনধারা ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। পরিবারের আয়ের একমাত্র উপার্জন জুমের খাসি পান।

প্রতিদিন বিকেলে জুম থেকে শ্রমিকরা খাচায় করে পান সংগ্রহ করে ঘরে আনার পর শুরু হয় বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়া। খাসিয়া পানের বড় বাজার বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল। এর বাইরে দেশে ও বিদেশে রয়েছে এর কদর।

সিলেটে প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ের আরেকটি আকর্ষণ খাসিয়া পল্লি। পিয়াইন নদীর পাশেই সমতলে এই খাসিয়া পল্লির অবস্থান। ঘরগুলো মাটি থেকে কিছুটা উঁচু করে তৈরি। প্রথমে নৌকা দিয়ে নদী পার হতে হয়। যাওয়ার পথে দেখা যায় সমতলে চা বাগান, সুপারি গাছে পান চাষের মতো বিষয়গুলো। 

খাসিয়াপল্লিতে রয়েছে খাসিয়া রাজবাড়ী, গির্জা, একটি স্কুল। খাসিয়া মেয়েরাই সংসারের প্রধান ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। মূল জীবিকা পান চাষ। 

ভারতের ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী একটি দুর্গম এলাকার নাম ডবলছড়া। ত্রিপুরা থেকে উৎপত্তি হওয়া একটি পাহাড়ি ছড়ার নামে স্থানটির নাম হলেও এটি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর ও আলীনগর ইউনিয়নকে ভাগ করে দিয়েছে।

খাসিয়াপল্লি ডবলছড়া পড়ে গেছে আলীনগর ইউনিয়নভুক্ত, আর ছড়ার এপারের ডবলছড়া চা বাগান এলাকা পড়ে গেছে শমশেরনগর ইউনিয়নে।

ডবলছড়া চা বাগান ও খাসিয়াপল্লি যেতে হলে পাহাড়ি উঁচু নিচু কাঁচা ১২ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। তবে শুরুতেই পথে শমশেরনগর চা বাগানের  প্রাকৃতিক হ্রদ, একটি বিশাল খেলার মাঠ ও ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালটি যেকোনো পর্যটকের মন ও দৃষ্টি কেড়ে নেয়।

উঁচু নিচু চা গাছের সারি যেন গালিচা বা বিছানা হয়ে পর্যটকদের ডেকে নিয়ে তার ওপর একটু ঘুমিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে। একটু সামনে গেলে একেবারে ত্রিপুরা সীমান্তের নো-ম্যান্স এলাকা। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দযের আঁধার হয়ে রয়েছে ডবলছড়া খাসিয়াপল্লিটি।

সমতল ভূমি থেকে প্রায় ২৫০ ফুট উঁচু-নিচু পাহাড়ি টিলার উপর ঘর করে বসবাস করছে খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোকজন। একজন হেডম্যান বা মন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে ৪০টি খাসিয়া পরিবার ডবলছড়ায় বসবাস করে থাকে। এত উঁচু ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করেও খাসিয়া পরিবারের সদস্যরা নিজেদের বসতভিটা ও পুরো পল্লিটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রতিটি খাসিয়া বাড়ির সামনে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সারা বছরের সঞ্চিত জ্বালানি কাঠ। আর এসব কাঠ এমনভাবে সারিবদ্ধভাবে তারা রেখেছে যে, এ যেন কোনো শৈল্পিক কাজ।

খাসিয়াদের পোশাক-পরিচ্ছদ সাধারণত বড় তিন টুকরা নানা বর্ণের কাপড়। এই আবরণ দিয়ে নিজেদের দেহাবরণ করে নেয় খাসিয়া মেয়ে ও নারীরা। পুরুষরা প্রচলিত যেকোনো পোশাকই পড়ে থাকেন।

ডবলছড়া খাসিয়াপল্লিতে ২৫০ ফুট উপরের হেডম্যান বা মন্ত্রীর বাংলোটির দেয়াল পাকা ও উপরে টিনের চাল। এটি এমনভাবে সাজানো রয়েছে যে, তা না দেখলে বোঝানো যাবে না। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে পর্যটকরা মৌলভীবাজার জেলা সদর, শ্রীমঙ্গল কিংবা শমসেরনগরে অবস্থান করে পছন্দনীয় গাড়ি ভাড়া করে ডবলছড়া ভ্রমণ করতে পারেন। তবে ডবলছড়া ভ্রমণে সবচেয়ে আরামদায়ক হচ্ছে স্থানীয় ফোর হুইলচালিত কিছু জিপও পিকআপ ভাড়া করা। 

চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অত্যন্ত দুর্গম নিরালাপুঞ্জিতে গেলে দেখতে পাবেন স্ট্রবেরি ফলের বাগান। সেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক।

নিরালাপুঞ্জিতে যাওয়ার রাস্তাটি মোটেও সহজ নয়। তাই এতটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অনেকেই এই নিরালাপুঞ্জিতে আসতে চান না। আবার বেশির ভাগ ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসু এই নিরালাপুঞ্জির নামই জানে না। বিদ্যুতের জন্য কাজ করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

নিরালাপুঞ্জির অপরূপ সৌন্দর্য আপনি না গেলে বুঝতেই পারবেন না, আদিবাসী খাসিয়ারা যেসব পাহাড়ি এলাকায় দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে, সেই গ্রামগুলোকে পুঞ্জি বলে। সাধারণত লোকালয় থেকে দূরে পাহাড়ি টিলায় এসব পুঞ্জি গড়ে ওঠে।

পুঞ্জিতে বসবাসকারী খাসিয়াদের একজন পুঞ্জিপ্রধান থাকে। তাকে মন্ত্রী বলা হয়। খাসিয়াদের আয়ের প্রধান উৎস খাসিয়া পান-সুপারি। এ ছাড়া বর্তমানে অন্যান্য চাষাবাদ, পশুপালনও করছে তারা।

মৌলভীবাজার জেলায় খাসিয়াপুঞ্জির সংখ্যা কম-বেশি ৫৫টি। এই পুঞ্জিতে বসবাস করে দেড় হাজার খাসিয়া পরিবার। বৃহত্তর সিলেটে এই সম্প্রদায়ের ৭২টি পুঞ্জি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বসবাস জাফলং এলাকায়।

বর্তমানে জাফলংয়ে চারটি পুঞ্জি রয়েছে। জৈন্তায় রয়েছে আরও দুটি পুঞ্জি। প্রতিটি পুঞ্জিতে গড়ে ৫০টি পরিবার বাস করে। (তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া, ইন্টারনেট ও খাসিমন্ত্রী পিডিশন প্রধান)

গান, কবিতা থেকে শুরু করে নাচ, নাটক, গল্প শিল্প-সাহিত্যের সব শাখাই খাসিয়াদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। লোককথা, পৌরাণিক কাহিনী, তন্ত্র-মন্ত্র খাসিয়া সংস্কৃতির জীবনবোধে সমৃদ্ধ।

নৃতাত্ত্বিক উৎস থেকে জানা যায়, প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ বছর আগে আসাম থেকে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে খাসিয়ারা সিলেট চলে আসে। সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বাইরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় খাসিয়াদের মূল বসবাস।

কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানীর মতে, নেত্রকোণা জেলার কিছু জায়গায় খাসিয়াদের ভাষাভাষি গোত্র বাস করে। তারা অনেকটা অবহেলিত।

খাসিয়ারা মূলত মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়। এ কারণে খাসিয়া সমাজে মেয়েদের বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে। এদের পরিবারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন নারী।

নারীরা কনেযাত্রী নিয়ে বিয়ে করে বর নিয়ে আসেন বাড়িতে। আর তারা নিজেদের বাড়িতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করে থাকেন।

মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত খাসিয়াদের কোনো পুরুষ সম্পত্তির মালিক হন না। সব সম্পদের মালিক হন নারীরা। তবে পরিবারের স্ত্রীর মূল্যায়ন বেশি হলেও স্বামী-স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা এমনভাবে মিলেমিশে বসবাস করেন, যেখানে পারিবারিক কলহ নেই বললেই চলে।

পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ মেয়ের ধনসম্পদে বেশি প্রাধান্য থাকে। এদের বংশ পরিচয় দেওয়া হয় মায়ের বংশানুক্রমে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, খাসিয়া আদিবাসীরা ছয়টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হলো লেংদু, সিংতে, লিংগাম, পনার, ভুই ও বার। ছয়টি গোত্রের মানুষ একই পুঞ্জিতে মন্ত্রীর অধীনে বাস করে।

খাসিয়াদের নিজ গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। অন্য গোত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে হয়। খাসিয়াদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। নৃত্য-সংগীত তাদের খুবই প্রিয়।

নানা ধরণের নাচগানে সবাই একত্র হয়। বিশেষত বড়দিনে আনন্দ করে। আদিবাসী খাসি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। নিজেদের ঐতিহ্যময় কৃষ্টি আর সংস্কৃতি চর্চায় হাসি-আনন্দে পুরাতন দিনগুলোকে বিদায় দিয়ে নতুনকে আহ্বান করে এই জনগোষ্ঠী।

ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে খাসিয়ারা ২৩ নভেম্বর খাসি বর্ষবিদায় “খাসি সেঙ কুটস্যাম” উদযাপন করে আসছে। ২৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয় খাসি বর্ষবরণ (স্ন্যাম থাইমি)। নিজেদের গদবাঁধা বনবাসী জীবন-সংগ্রামের ফাঁকে কিছু সময় তাদের জন্য বিশেষ উৎসবের উপলক্ষ্য নিয়ে আসে। 

খাসিয়ারা এক সময় প্রকৃতি-পূজারী ছিল। এখন খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে এদের প্রায় বেশির ভাগ খ্রিস্টান। তাদের ছেলেমেয়েরা এখন মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া শিখছে।

ভৌগোলিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা ও প্রশাসনিক অনেক কারণে প্রচুর বাংলা শব্দ খাসি ভাষায় অবিকৃত অবস্থায়, অথবা আংশিক পরিবর্তিত হয়ে প্রবেশ করেছে। তা এখনো জারি আছে। অন্য ভাষার মতো খাসি ভাষা অঞ্চলেও কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।

অঞ্চলভেদ বিচার করে খাসি ভাষাকে প্রধান চারটি ভাষা অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে ওয়ার (কুলাউড়া অঞ্চলের খাসি ভাষা), প্লারর (ভারতের মেঘালয়ে ও সিলেটের জৈন্তিয়ায় বসবাসকারীদের ভাষা), আমজলং (মৌলভীবাজারে প্রচলিত খাসি ভাষা) এবং নংউয়া (সুনামগঞ্জে প্রচলিত খাসি ভাষা)।

খাসিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা রক্ষা করা দরকার। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে সংস্কৃতির এই অনুষঙ্গ।

আমাদের মানচিত্র থেকে অনেক ছোট ছোট সম্প্রদায় ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। এখনো যেগুলো টিকে আছে, তাদের রক্ষা করা দরকার। এই জাতিগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। 

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কমের সম্পাদকীয় নীতির মিল না- থাকতে পারে।]