
শাড়ি বুনছেন দুই জামদানি শিল্পীরা। ছবি: প্রিয়.কম
ব্যস্ত জামদানি পল্লি
আপডেট: ০১ জুন ২০১৮, ০৯:৪১
(প্রিয়.কম) বিশ্বে স্বতন্ত্র নামে পরিচিত অভিজাত তাঁতবস্ত্র জামদানি। বিশ্বখ্যাত মসলিন শাড়ির বর্তমান সংস্করণ জামদানি শাড়ি। নারীর সৌন্দর্যকে অনন্য করে তুলতে জামদানি অপরিহার্য। নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের জামদানি বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিতি দিয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়া জামদানি পল্লিতে তাঁতিদের কর্মব্যস্ত দিন কাটছে এখন। এবার প্রায় ৪৫ কোটি টাকার জামদানির চাহিদা রয়েছে বলে তাঁতিরা দাবি করেছেন।
শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত নোয়াপাড়া গ্রাম। গ্রামজুড়ে সারিসারি তাঁত। চোখে পড়ে তাঁতিদের কর্মচাঞ্চল্য। প্রায় প্রতিটি ঘরে তাঁতে কাজ চলছে। কেউ সুতা কাটছে। কেউ ব্যস্ত হাতে তাঁত টানতে। সুতা তুলছেন কেউ; কেউবা সহযোগিতা করছেন অন্যজনকে। তৈরি হচ্ছে হরেক রকম নকশার জামদানি শাড়ি। একটু ফিরে তাকানোর যেন ফুরসত নেই ওদের। নাওয়া-খাওয়া ভুলে জামদানি শিল্পীরা এখন কাপড় বুনে যাচ্ছেন।

শাড়ি বুনার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন দুই শিল্পী। ছবি: প্রিয়.কম
জামদানির মূল আকর্ষণ নকশা। ক্রেতার রুচি আর চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নকশার কাজ করতে হয়। এখন পাখি, সূর্যমুখী, ময়ূর, মাছ, লতাপাতা, ইত্যাদি উঠে এসেছে জামদানির নকশায়। বর্তমানে ফুলতেরছি, ছিটার তেরছি, ছিটার জাল, সুই জাল, হাটু ভাঙ্গা, তেরছি, ডালম তেরছি, পার্টিরজাল, পান তেরছি, গোলাপ ফুল, জুঁই ফুল, পোনা ফুল, শাপলা ফুল, গুটি ফুল, মদন পাইর জামদানির চাহিদা বাজারে রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে ছিটার জাল, সুই জাল ও পার্টির জাল জামদানির মূল্য সবচেয়ে বেশি। এসব জামদানি শাড়ির দাম পড়ে পাঁচ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত।
অভিনব হাট:
শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের ঢাকার ডেমরার জামদানি হাটের কথা কমবেশি সবারই জানা। এটি এক অন্যরকম হাট। দিনে নয়, রাতে বসে এ হাট। তাও আবার মধ্যরাতে শুরু হয়ে শেষ হয় সূর্যোদয়ের আগেই। ভোর ৪ টায় পুরো জমজমাট হয়ে ওঠে হাট।
তখন ফড়িয়া, দালাল, জামদানি তাঁতি ও ব্যবসায়ীতে পূর্ণ থাকে। কেউ তিন সপ্তাহব্যাপী বোনা শাড়ি, আবার কেউ চার সপ্তাহব্যাপী বোনা শাড়ি বলে হাকডাক দিয়ে থাকেন। পছন্দ হলেই ক্রেতারা তা দরদাম করে কিনে নেন। প্রতি হাটে এখানে বিক্রি হয় পাঁচ থেকে সাত হাজার পিস শাড়ি। লেনদেন হয় কয়েক কোটি টাকার ওপরে।
কয়েকজন জামদানি শাড়ি বিক্রেতা জানান, ঈদকে সামনে রেখে কয়েক কোটি টাকার জামদানি বেচাকেনা হবে।

শাড়ি প্রক্রিয়াজাতে ব্যস্ত দুই শিল্পী। ছবি: প্রিয়.কম
রফতানি:
বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, সৌদি আরব, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে জামদানি শাড়ি রফতানি হচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ২৫০ কোটি টাকার জামদানি শাড়ি রফতানি করা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, করাচি, লাহোর ও ইউরোপে বসে প্রতিবছর জামদানির মেলা।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সিদ্ধান্ত প্রদানে সরকারের দীর্ঘসূত্রতা, প্লট প্রদানে অনিয়ম, প্রকৃত জামদানি তাঁতিদের মধ্যে প্লট হস্তান্তর না করা ও ব্যাংক ঋণের অপ্রতুলতার কারণে দেশের একমাত্র জামদানি পল্লি প্রকল্পের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
এ ছাড়া বিসিকের নজরদারির অভাবে ৪৩৫টি প্লটের পুরো প্রকল্পে ১১০টি মাত্র জামদানি কারখানা গড়ে উঠেছে। যাদের নামে প্লট বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে তাদের অধিকাংশই জামদানি শিল্পের সঙ্গে জড়িত না থাকায় রূপগঞ্জের নোয়াপাড়ার এ জামদানি প্রকল্পে এখনও শিল্প গড়ে উঠছে না।
কারিগরদের সংখ্যা:
জামদানি শিল্পীদের সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে এখানে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার জামদানি তাঁতি ছিল।
জামদানি তাঁত শিল্প শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আড়াই দশক আগেও এ সংখ্যা ছিল দেড় লাখ। বর্তমানে চার হাজার পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। নানা প্রতিকূলতার কারণে দিন দিন কমছে জামদানি তাঁতির সংখ্যা।’
বিসিকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এলাকার তিন হাজার ১১৫টি পরিবারের ১৯ হাজার ৩০৯ জন শিল্পী জামদানি শাড়ি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এখানকার জামদানি তাঁতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৭০০টি। এর মধ্যে দুই হাজার তাঁত ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
তাঁতিদের অভিযোগ, জামদানি শিল্পীদের লাভের গুড় খাচ্ছে পিঁপড়ায়। মহাজন ফড়িয়ারাই তাদের লাভের অংশ ছিনিয়ে নিচ্ছে। শাড়ি প্রতি মজুরি হিসেবে একজন পায় মাত্র দুই থেকে আড়াইশ টাকা। পুঁজির অভাবে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছেন না তাঁতিরা।
রূপগঞ্জের রূপসী কাজীপাড়া এলাকার অশীতিপর জামদানি শিল্পী ফালু মিয়া ১৯৫০ সাল থেকে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ফালু বলেন, ‘জামদানি শিল্পীরা এখন আর ভাল নেই। টিকে থাকতে না পেরে অনেকেই তাঁত বেচে দিয়েছে। ৩০/৩৫ বছর আগে একটি শাড়ি তৈরিতে দেড় টাকা খরচ হলে বিক্রি হতো আট থেকে ৯ টাকায়। কিন্তু শিল্পীদের এখন তেমন লাভ থাকে না। বর্তমানে এক সপ্তাহে বোনা এক হাজার ২০০ টাকার একটি শাড়ি বিক্রি হয় বড় জোর দুই হাজার টাকায়। আর লাভের সিংহভাগই কেড়ে নিচ্ছে ফড়িয়া, দালাল আর মহাজনরা।’
প্রিয় সংবাদ/নোমান/রুহুল