
স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল শিখা চিরন্তন। ছবি: লেখক
কেন এই শিখাটি জ্বলবে চিরকাল?
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:২২
(প্রিয়.কম) বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে কোনো ভাবেই আলাদা করে দেখা যায় না। এই স্থানটির প্রতিটি অংশই বাঙ্গালীর স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। সেই আদি কাল থেকে এই স্থানটি উদ্যান রূপেই রয়েছে। নানান রাজনৈতিক পালা বদলে নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। হয়েছে গৌরবোজ্জ্বল সব ইতিহাসের সাক্ষী।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিষ্ঠাকাল মুগল আমল। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবাদার ইসলাম খান ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠা কালে উদ্যানটি প্রতিষ্ঠা করেন। মুগল শাসনের অবসানকালে এটি অব্যবস্থাপনার দরুন পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার ব্রিটিশ কালেক্টর মি. ডয়েসের বিশেষ পরিকল্পনায় আবারো প্রাণ ফিরে পায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এসময়েই চারপাশে কাঠের বেড়া দিয়ে ঘোড়দৌড়ের উপযোগী করে তৈরি করা হয় উদ্যানটিকে। নাম দেওয়া হয় রমনা রেসকোর্স ময়দান। নাজির হোসেন রচিত 'কিংবদন্তির ঢাকা' গ্রন্থটি অনুসারে "ব্রিটিশ আমলে রমনা ময়দানটি ঘোড়দৌড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। প্রতি শনিবার হতো ঘোড়দৌড়। এটা ছিল একই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসক ও সর্বস্তরের মানুষের চিত্তবিনোদনের একটি স্থান।“
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঘোড়দৌড়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে সরকার ১৯৪৯ সালে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেয়। তারপর নানান সংস্কার কাজ করা হয়। কিন্তু নামটি অপরিবর্তিত থাকে।
পাকিস্তান আমলেই এই স্থানটি প্রথমবারের মতো বাঙ্গালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে। আর তা হয় ১৯৬৯ সালে। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের জেল মুক্তির পর রমনা রেসকোর্সে এক নাগরিক সংবর্ধনায় তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এর মাত্র ২ বছর পর ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রমনা রেসকোর্সে এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে এবং এই সমাবেশে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যগণ প্রকাশ্যভাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং তারা ওয়াদা করেন পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের চাপের মুখেও বাংলার মানুষের স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।
এই শপথকে অটুট রেখে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই এক মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন এবং ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ঘোষণার মাধ্যমে কার্যত দেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি সৈন্যগণ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এমন আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
ঐতিহাসিক এই স্থানটিতে মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসকে সকলের সামনে তুলে ধরতে ও অটুট রাখতে ১৯৯৬ সালে শিখা চিরন্তন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঠিক যেই স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন সেই স্থানটিতেই এই শিখা প্রজ্বলনের পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৯৭ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিখা চিরন্তন প্রজ্বালন করেন। তার এই প্রজ্বলিত শিখা একটি দেশব্যাপী শোভাযাত্রার মাধ্যমে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ছুঁয়ে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছায়। ওই দিন এটি পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদানের স্থানটিতে স্থাপন করেন বিশ্বনন্দিত চার নেতা। এই চার নেতা হলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, তুরস্কের সুলেমান ডেমিরেল এবং বাংলাদেশের তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ।
একই সমান্তরালে জ্বলছে শিখা বিরন্তন, উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীনতা টাওয়ার। ছবি: লেখক।
সেদিন থেকেই এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এটি পরিদর্শনের জন্য কোনও ফি প্রদান করতে বা টিকিট কাটতে হয় না। যে কেউ চাইলে সপ্তাহের যে কোনো দিন স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল এই শিখা চিরন্তন দেখতে যেতে পারেন।
আমরা প্রিয়.কম থেকে সরাসরি গিয়েছিলাম এর বর্তমান অবস্থা দেখতে। আমরা গিয়ে দেখলাম পরিস্থিতি অত্যন্ত ভালো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবার চেষ্টা যেকোনো দিকেই চোখে পড়ে। একজন আনসার সদস্য ছিলেন এর পাহারাদার হিসেবে। তাকে আমরা দেখি প্রচণ্ড ব্যস্ত। কারণ প্রতি মুহূর্তে মানুষ বিভিন্ন দিক থেকে এই শিখার কাছে চলে যায়। উঠে পড়ে বেদিতে আর বসে দাঁড়িয়ে না ভঙ্গিমায় ছবি তোলার বিড়ম্বনা তো আছেই। আর তাই সারাক্ষণই তিনি বাঁশি বাজিয়ে জনে জনে সতর্ক করে যাচ্ছেন। তার মতে যারা এখানে আসেন তাদের বেশিরভাগই এই শিখা চিরন্তনের পেছনের ইতিহাস জানেন না। তাদের কাছে এটি আর ১০টি সাধারণ ভ্রমণের স্থানের মতোই। তাই এদের মাধ্যমে নানান অবমাননা ঘটে এই শিখার। এই কারণেই এসব ভ্রমণকারীদের প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
তাই পাঠকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনারা এই স্থানটি দেখতে গেলে অবশ্যই কোনো রকম অবমাননাকর আচরণ করবেন না।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, উইকিপিডিয়া, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলাদেশের ইতিহাস (১৭০৪-১৯৭১)।
গুগল ম্যাপে দেখে নিন শিখা চিরন্তনের অবস্থান।
সম্পাদনাঃ প্রিয় ট্রাভেল/জিনিয়া
প্রিয় ট্রাভেল সম্পর্কে আমাদের লেখা পড়তে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেইজে। যে কোনো তথ্য জানতে মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। ভ্রমণ বিষয়ক আপনার যেকোনো লেখা পাঠাতে ক্লিক করুন এই লিংকে - https://www.priyo.com/post।