
ছবি সংগৃহীত
ছবিয়ালের ১২ সিনেমা বিশ্বব্যাপী একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে: শরাফ আহমেদ জীবন
আপডেট: ১৩ মে ২০১৭, ১৪:১৫
শরাফ আহমেদ জীবন। ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল; প্রিয়.কম।
(প্রিয়.কম) শরাফ আহমেদ জীবন। তিনি ছবিয়াল পরিবারের একজন সদস্য। ২০০২ সালে তিনি মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর সান্নিধ্য পান। তিনি একাধারে নাট্য ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা। অতঃপর নাট্য নির্মাণ থেকে বিজ্ঞাপন নির্মাণে মনস্থির করেন তিনি। তার নির্মিত প্রথম নাটক ‘ঘর নাই’, যা ২০০৬ সালে নির্মিত হয়েছিল। এরপর হাওয়াই মিঠাই, সিরিয়াস একটি কথা আছে, ছায়াবাজিসহ আরও বেশকিছু নাটকের সফল নির্মাতা তিনি। এ যাবত নির্মাণ করেছেন শতাধিক বিজ্ঞাপন। গ্রামীণ ফোনের কিছু বিজ্ঞাপন, নাম্বার ওয়ান চা, ইউক্যাশ, বিকাশ, মরটিন ও প্রাণ কোম্পানি ছাড়াও দেশীয় কিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বহুল প্রচলিত পণ্যের বিজ্ঞাপনের নির্মাতা শরাফ আহমেদ জীবন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে ছবিয়াল পরিবারের রিইউনিয়ন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ছবিয়ালের ১২ জন পরিচালক নিয়ে ফিরছেন ঈদুল ফিতরে। শরাফ আহমেদ জীবন উক্ত ১২ জনেরই একজন। নাটক, বিজ্ঞাপন ও ছবিয়ালের রিইউনিয়ন প্রসঙ্গে শরাফ আহমেদের সঙ্গে এক বিকাল আড্ডা হয় ‘প্রিয়.কম’ এর। কুশিলাদি বিনিময়ের পর প্রিয়.কম এর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
প্রিয়.কম: নাট্য নির্মাতা থেকে বিজ্ঞাপন নির্মাতা। মধ্যখানের সফরটি কেমন ছিল?
শরাফ আহমেদ জীবন: বিজ্ঞাপনে আসার কারণ ছিল, আমি যে নাটকগুলো বানাতাম, প্রতিটি নাটকে ‘লস’ হতো। লস হওয়াটাই ছিল মেইন কারণ। তো যেহেতু লস হতো, তাহলে এখন কী করা যায়? লস তো কাভার করতে হবে। আমি প্রডিউসার পেতাম না। আমি নিজে কিছুদিন প্রডিউস করলাম। নিজে প্রডিউস করেও দেখলাম যে- না, চলতে পারছি না। তারপর মাঝখানে কিছুদিন রেস্ট নিলাম। চাকরি শুরু করলাম। অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সিতে চাকরি নিলাম। এটি ছিল ২০০৯-১০ সালের দিকে। ২০১০ সালে চাকরিরত অবস্থায় কিছু কাজ করলাম, গ্রামীণ ফোনের একটি কাজ পেলাম। সিপি অফার নামে একটা অফার পেলাম। তিনটি বিজ্ঞাপনে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা! আমাকে আমার এক ভাই (তিনি এখন রবিতে আছেন) বললেন- ‘একটা বিজ্ঞাপন নির্মাণের সুযোগ আছে, আপনি তো নাটক নির্মাণ করেন, বিজ্ঞাপন নির্মাণ করবেন কি-না?’ আমি বললাম- ‘অবশ্যই করব’। তখন আমি ইন্টারস্পিড নামক একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে চাকরি করি। আমি ভাবলাম- ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা! আমরা তো এক থেকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে নাটক বানিয়ে ফেলি, সেক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন থেকে আসা ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা তো বিশাল টাকা! আমি একদিনেই তিনটি বিজ্ঞাপনের শ্যুট করে ফেললাম। ছোট ছোট ডায়ালগ ছিল। এডিট করে বিজ্ঞাপন রেডি হয়ে গেল। আমার প্রায় দেড় লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। এই যে দেড় লাখ টাকা লাভ হলো- এই লাভটিই আমাকে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী বা লোভী করে দিলো বিজ্ঞাপন নির্মাণের ক্ষেত্রে। আমার একটা আগ্রহ জন্ম নিল বিজ্ঞাপন নির্মাণের প্রতি। আমি আমার করা কাজ ইন্ডাস্ট্রির ক্রিয়েটিভ লোকেদের দেখিয়ে বলতাম-‘ভাইয়া, এমি এটা করেছি’। তা ছাড়াও, বিজ্ঞাপন টিভিতে যাচ্ছে। একটি নাটক তো টিভিতে একবার দেখালেই শেষ। বিজ্ঞাপন তো বারবারই টিভিতে দেখায়। এরপর আমি সিটিসেলের একটি কাজ পেলাম- ইন্টারস্পিডে চাকরি করাকালীনই। এভাবেই বিজ্ঞাপনে আমার ধীরে ধীরে ঢোকা। ইন্টারস্পিডে ১১ মাস চাকরি করেছিলাম, সেখানে বিজ্ঞাপনের বেসিক লার্নিংটা তৈরি হয়েছিল আমার।
প্রিয়.কম: বিজ্ঞাপন নির্মাণে মনোনিবেশ করার ক্ষেত্রে আপনার ব্রেকিং পয়েন্ট ছিল কোনটি?
শরাফ আহমেদ জীবন: প্রথম আমার যে টার্নিংটা ছিল, সেটা ২০১১ সালে গ্রে-এর গাউসুল আজম শাওন ভাইয়ের মাধ্যমে পাওয়া। উনার সঙ্গে আমার পূর্ব থেকেই সম্পর্ক ছিল। উনার একটি কাজ পেলাম- ক্রিকেট ওয়ার্ল্ডকাপের। সেখানে তিনটি ছোট বিজ্ঞাপন বানাতে চাইছিলেন তারা। বিজ্ঞাপনগুলো কাকে দিয়ে বানাবেন- তেমন মানুষ খুঁজছিলেন। তখন হঠাৎ করে শাওন ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল, তিনি বললেন- ‘তুমিই তাহলে বানাও। তোমারা তো নাটকের লোক, তোমরা ফিকশন ভালো বোঝো, তোমরা করো’। তখন আমি অ্যাডভারটাইজিং বিষয়ে তেমন ভালো বুঝিও না। আমার টার্গেট ছিল আমার করা কাজ যাতে শাওন ভাই পছন্দ করেন। তাঁকে পছন্দ করাতে পারলে আমার জন্য রাস্তাটি সহজ হয়ে যাবে। ততদিনে আমি ইন্টারস্পিডের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছিল যে- আমি বাইরে সময় দেবো। শাওন ভাইয়ের দেওয়া তিনটি বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছিলাম এবং সাম-হাউ বিজ্ঞাপনগুলো ভালো হয়েছিল। ওগুলো ভালো হওয়ার কথা ছিল না, কারণ আমি বিজ্ঞাপনের বাইরের থিওরি দিয়ে বিজ্ঞাপন তিনটি নির্মাণ করেছিলাম। যেভাবে নাটক তৈরি করি, সেভাবে তৈরি করেছিলাম। যেহেতু কনটেন্ট ভালো ছিল, আমার উদ্দেশ্য ভালো ছিল, গল্প, চরিত্র সবই ভালো ছিল, হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে এক ধরনের সাহায্য করেছেন, তাই সব কিছু ব্যাটে বলে মিলে গিয়েছিল। আমার কাজ শাওন ভাই পছন্দ করেছিলেন। পছন্দ করে আমাকে গ্রামীণ ফোনের বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতে দিলেন দুটি। সেগুলো করলাম, সেগুলোও সাম-হাউ ভালো হয়ে গেল, এরপর ধীরে ধীরে আরও কাজ করা শুরু করলাম। যেহেতু শাওন ভাইয়ের দেওয়া পরপর দুটি প্রোজেক্টে আমি ভালো করে ফেললাম, তাই একটার পর একটা কাজ পেতে থাকলাম। এটা আমার লাক।
প্রিয়.কম: ‘লাক’ বলছেন কেন? এগুলো তো আপনার ক্রিয়েটিভিটির ফলাফলও হতে পারে?
শরাফ আহমেদ জীবন: এটা আমি এজন্য লাক বলছি কারণ- তখন আমার চেয়ে বেশি ক্রিয়েটিভিটিওয়ালা লোকজন তখন আমার আশেপাশে ছিল। কিন্তু তারা সেই সুযোগটি পাননি। আমি সেই সুযোগ পেয়েছিলাম। এজন্য আমি ‘লাক’ বলছি। যদিও আমি ‘লাক’এ বিশ্বাসী না, আমি মিরাকেলে বিশ্বাসী। এটিকে লাক না বলে মিরাকেলও বলা যায়। যেহেতু অন্য মেধাবিরা চান্স পাচ্ছিলেন না, আমি সেই চান্স পেয়েছিলাম- এই প্রসঙ্গে এটাকে লাক বলছি আমি। এই যে শাওন ভাইয়ের সংস্পর্শে যাওয়া, মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী ভাইয়ের সংস্পর্শ পাওয়া, ইন্টারস্পিডে চাকরি পাওয়া- এগুলো মিরাকেলের মতোই ঘটনা।
শরাফ আহমেদ জীবন। ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল; প্রিয়.কম।
প্রিয়.কম: নাটক ছেড়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতা হয়ে লাভ কী হলো?
শরাফ আহমেদ জীবন: বিজ্ঞাপনে ঢোকার পরেও আমি কিন্তু মাঝে মধ্যে ফিকশন করতাম, মানে নাটকের কাজ আরকি। সেটা মাঝে মাঝে করতাম। কিন্তু মনোযোগ আসলে নাটকের চেয়ে বিজ্ঞাপনেই বেশি থাকত। কারণ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অল্প সময়ে বেশি টাকা পাওয়া যায়। বিজ্ঞাপনে কাজের ফ্রীডম থাকে, রিটার্নটা খুব ভালো। আগেতো বাঁচতে হবে। এছাড়াও ঐ সময় নাটকের মান তলানির দিকে যাচ্ছিল। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের জায়গাটি ছিল আমার জন্য অনেক বড় জায়গা। ঠিকঠাক মতো পয়সা পাচ্ছি। আমি দেড় রুমের একটি বাসায় থাকতাম, বিজ্ঞাপন নির্মানের মাধ্যমে আমার জীবন যাপনের পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে। আমি একটি ছোট গাড়িও কিনে ফেলতে পারলাম। ধীরে ধীরে আমার অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এলো। আমার কোনো অফিস ছিল না, আমি অফিস নিলাম। এই সব কিছুই এসেছে বিজ্ঞাপন থেকেই। এ সবের পেছনে সবচেয়ে বড় ক্রেডিট আমি গাউসুল আজম শাওন ভাইকে দিই। এছাড়াও আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, সবাই আমাকে একধরনের মূল্যায়ন বা কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সান-কমিউনিকেশনের তানভির ভাইও আমাকে খুব হেল্প করেছেন। এছাড়াও আরও অনেকেই রয়েছেন।
প্রিয়.কম: মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী’র সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কীভাবে?
শরাফ আহমেদ জীবন: ফারুকী ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের বিষয়টা যদি বলি, তাহলে অনেকেই মনে করবে যে- আমি বোধহয় বাড়িয়ে বলছি। আমার টার্গেট ছিল আমি এসবের সঙ্গে যুক্ত হব। সেই টার্গেট পূরণ করার জন্য আমি আমার গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় আসার পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাই। সেটা ছিল ১৯৯৯-২০০০ সেশনে। আমি এফ,রহমান হলে থাকতাম। তখন আমি আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে ফারুকী ভাইয়ের ‘চড়ুইভাতি’ টেলিফিল্মটির প্রিমিয়ার শো-তে গিয়েছিলাম, শাহবাগ জাদুঘরে। এটি ২০০১ এর দিকের ঘটনা। সেদিন ফারুকী ভাইকে খুব কাছে থেকে দেখলাম। এর আগে একটি বেসরকারি টিভিতে তার একটি নাটক চলত, সেটার খুব ভক্ত ছিলাম আমি। রেগুলার দেখতাম। তখন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী বলতে আমি ভাবতাম যে- হয়তো বয়স্ক কোনো লোক হবে। পরে চড়ুইভাতি’র প্রিমিয়ারে এসে দেখি- আরে এ তো আমাদের মতোই লোক! এই লোকের এত সুন্দর ক্রিয়েশন! আমার চিন্তায় ঢুকল- এই লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হতে হবে। কিন্তু সরওয়ার ফারুকী ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় ছিল না। এর মাস চারেক পর চারুকলায় ‘মামুনুল হক’এর সঙ্গে আমার দেখা হয়। মামুনল হক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হলাম। আমি উনার কাছে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর নম্বর চাইলাম। উনি নম্বর দিলেন। পরেরদিনই আমি ফারুকী ভাইকে কল দিলাম। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। কয়েকদিন ফোন দিলাম। হঠাৎ করে ফোন ধরলেন একদিন। আমি আমার পরিচয় দিলাম। আমি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি- সেটাও তাঁকে বললাম, যাতে আমাকে তিনি একটু মূল্যায়ন করেন। আমি উনাকে বললাম- ‘আপনার চড়ুইভাতি দেখেছি, খুব ভালো লেগছে’। উনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিলেন! তার দুদিন পর আমি আবার ফোন দিলাম, বললাম-‘আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই’। তিনি উত্তর দিলেন-‘আপনি আমার সঙ্গে কাজ করতে চান ভালো কথা। আমার এখানে তো অনেক লোকজন আছেন, আপাতত আমাদের এখানে কোনো লোক লাগবে না। তবে আমাদের এখান থেকে যদি কেউ মরে যায়, তাহলে আপনি সুযোগ পাবেন’। এই বলে ফোন রেখে দিলেন। আমি দেখলাম- কোনোভাবেই তাঁকে ধরা যাচ্ছে না। কয়েকদিন পর আমি ভাবলাম- এভাবে হবে না, থিওরি বদলাতে হবে। কয়েকদিন পর আবার ফোন করলাম, আমার পরিচয় দিলাম। তখন মনে হলো- তিনি আমার উপর কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। তবুও আমি বললাম-‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই, আমি আপনাকে আজিজ সুপার মার্কেটে দেখেছি’। তিনি উত্তর দিলেন- ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি আসেন একদিন’। ততক্ষণে আমি তাঁকে পটিয়ে-পটিয়ে ‘তুমি’ সম্বধনে নিয়ে এলাম। বললাম-‘ভাইয়া, আমি তো আপনার অনেক ছোট, আমাকে তুমি করেই বলবেন’। তো আমি একদিন আজিজে গেলাম উনার সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে ‘আশুতোষ সুজন’ ছিলেন। ফারুকী ভাই আমাকে দেখে বললেন-‘আরে, তুমি তো পিচ্চি ছেলে! কী চাও বল?’ আমি বললাম-‘ভাই আপনার প্রোডাকশনে তো টি-বয় হলেও একজন মানুষের দরকার হয়, আমি আপনার প্রোডাকশনে কাজ করতে চাই, আমাকে ঐ সুযোগটা দিন’। তখন তিনি আমাকে একটি ডেট দিলেন এবং একটি বাড়ির ঠিকানা দিলেন। আমাকে যেতে বললেন। বাড়ির ঠিকানা ছিল- মহাখালী। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে- আমি সেই ঠিকানা খুঁজতে চলে গিয়েছিলাম ধানমণ্ডি! রাস্তা নম্বর মিলে গিয়েছিল কিন্তু বাড়ি খুঁজে পেলাম না। সেখান থেকে আবার আমি তাঁকে ফোন দিয়ে বললাম-‘আমি তো ধানমণ্ডি এসে রোড খুঁজে পেয়েছি কিন্তু বাড়ি তো খুঁজে পাই না’। তিনি বললেন-‘আমি তো তোমাকে মহাখালী আসতে বলেছিলাম। তুমি ধানমণ্ডিতে গেলে কেন?’ আমি বললাম-‘তাহলে তো আমার ভুল হয়ে গিয়েছে, আমাকে কি আরেকটি সুযোগ দেওয়া যাবে?’ তিনি বললেন যে-‘ঠিক আছে, তুমি আগামীকাল আসো’। পরের দিন গিয়ে দেখি সেখানেও আশুতোষ সুজন! ও আমার আমার আগেই চলে গিয়েছে। এই হচ্ছে ফারুকী ভাইয়ের কাছে আমার যাওয়া এবং কাজ শুরু করা।
শরাফ আহমেদ জীবন। ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল; প্রিয়.কম।
প্রিয়.কম: তাঁর কাছে গেলেন, আর ওমনি তিনি আপনাকে নিয়ে নিলেন?
শরাফ আহমেদ জীবন: আমি ও আশুতোষ সুজন একই সঙ্গে ফারুকী ভাইয়ের সান্নিধ্যে গিয়েছিলাম। মানে আমরা দুজনেই তার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী ছিলাম। আমরা দুজনেই যখন তার কাছে গেলাম, তখন তিনি কাকে রাখবেন- সেটা নিয়ে একটা দ্বিধা সৃষ্টি ছিল। আমি যখন ফারুকী ভাইয়ের দেওয়া ঠিকানায় যাই, তখন দেখি আশুতোষ সুজন সেখানে আমার আগেই উপস্থিত! তাই ফারুকী ভাই আমাকে ডেকে বললেন-‘দেখো জীবন, আমি তো দুজনকে একসঙ্গে নিতে পারব না, আশুতোষ সুজন আপাতত এই চাংকটা করুক, নেক্সট চাংক তুমি কোরো। তুমি মন খারাপ কোরো না’। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! তখন সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল আশুতোষ সুজনের ওপর। যা হোক, ফারুকী ভাইয়ের কথা শোনার পর যখন বাসার নিচে নেমে এলাম, তখন আবার ডাক পড়ল। এবার তোজো ভাই ডেকে বললেন- ‘জীবন, আগামীকাল সকালে আপনিও আসবেন’। আমি কিছুটা অভিমানী কণ্ঠেই বললাম- ‘ফারুকী ভাই তো নিষেধ করলেন’! তখন তোজো ভাই বললেন- ‘না না, কোনো সমস্যা নেই, আমিতো আপনাকে বলছি, আপনি আগামীকাল আসেন’। এরপর আশুতোষ সুজনের সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলাম। সুজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাতায়াত করেছি। ওর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল আমার তখন থেকেই। এভাবেই ফারুকী ভাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হলাম, একান্নবর্তীতে থাকলাম, ফিল্ম শুরু হলো, মেইড ইন বাংলাদেশ হলো, ৬৯ হলো, ৪২০ হলো। এভাবেই মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সঙ্গে আমার সংযুক্তি।
প্রিয়.কম: আপনার কর্মজীবনে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর অবদান কেমন?
শরাফ আহমেদ জীবন: তিনি আমাকে অনেক সুযোগ দিয়েছেন। আমি কোনো সমস্যায় পড়লে, তার কাছে সমাধান চাইতাম। তিনি সমাধান দিতেন, এখনও দেন। এমনকি তার সঙ্গে কাজ করার এক বছর যেতে না যেতেই ব্যাচেলরের পোস্টের কাজে তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন ইন্ডিয়া। মেইড ইন বাংলাদেশের পোস্টের কাজে পাঠালেন। তার খুব কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেয়েছি আমি। অনেক বিষয়ে আমি উনার সঙ্গে ডিবেট করতাম, যে ডিবেট হয়তো অন্যরা করতে পারত না। আমাকে একধরনের প্রশ্রয় তিনি আগেও দিয়েছেন, এখনও দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রিয়.কম: ‘প্রশ্রয়’ অর্জন করলেন কীভাবে?
শরাফ আহমেদ জীবন: এটা আমার ক্রেডিট না, এই ক্রেডিট হলো তাঁর। তিনি মানুষ হিসেবেই এমন। আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দীর্ঘদিন যাবত দেখেছি। মানুষ হিসেবেই তিনি ভালো লাগার মতো। তিনি ইমপ্রেস করতে পারেন মানুষকে। আমাকে তার ভালো লাগার কারণ ছিল ‘কাজ’। আমার চেয়ে মেধাবি তখন অনেকেই ছিলেন, এখনও আছেন। আমি একটু স্পেশাল ছিলাম আমার একটিভিটির কারণে। কারণ আমি যখন যেটা ধরতাম, সেটা করেই ছাড়তাম। যে কারণে তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়ে পরবর্তীতে কাজটি বুঝে নিতে পারতেন। আমি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতাম। যে কারণে আমি হয়তো অন্যদের চেয়ে একটু এগিয়ে ছিলাম।
প্রিয়.কম: আমার জানামতে একজন নাট্য নির্মাতা হিসেবে আপনার মনে নাটকের বাজেট পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে...
শরাফ আহমেদ জীবন: হয়তো নিজেকে সেভাবে প্রেজেন্ট করতে পারিনি। বেশি বাজেট পাওয়ার জন্য নিজেকে সেল-অ্যাবল করতে পারিনি হয়তো। এটা আমার একটি ব্যর্থতা। আরেকটি ব্যর্থতা হচ্ছে- যুগের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে আমি নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি। আসলে যে ট্রেন্ডটি ছিল, মানুষ যেভাবে কাজ করে, সেই ট্রেন্ডটি আমার খুব একটা ভালো লাগত না। আমার টার্গেট ছিল সিনেমা বানান। সিনেমা মানে- আমি আমার নিজের কথাগুলো বলতে চাই। আমি আমার গল্প মানুষের কাছে শেয়ার করতে চাই। কিন্তু যে প্রডিউসার, তিনি কিন্তু আমার কথাগুলো বলতে চান না। তিনি বলতে চান তার কথা। তিনি তাঁর বাণিজ্যের বিষয়টা ভালো বুঝতে চান। কেউ কেউ আবার ঘোরায়। তাই এখানে একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গেল। তাছাড়াও মার্কেট খুব দ্রুত পড়ে যাচ্ছিল একটা সময়। এখন হয়তো বা রাইজ করছে। তখন আমার মনে হয়েছিল যে- না, এই জায়গাটি আমার জন্য নয়। আমাকে সার্ভাইবের জন্য ট্র্যাক পরিবর্তন করতে হবে কিংবা এই সেক্টরেই যদি থাকি, তাহলে বিজ্ঞাপন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। যে কথাগুলো আমি আগেই বলেছি। তাই নাটক নির্মাণ থেকে বিজ্ঞাপন নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েছি।
প্রিয়.কম: আপনার গ্রামের বাড়িতে আপনি ‘ফিশারী’ ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন। এটি কি সার্ভাইব করার জন্যই, নাকি কোনো অভিমান থেকে?
শরাফ আহমেদ জীবন: ফিশারী কিন্তু এখনও আছে। কোনো অভিমান থেকে নয়। এটা তো গত বছর থেকে শুরু করেছি। মানে ২০১৫ এর শেষের দিকে শুরু করেছি এটি। এখন খুব পজেটিভ জায়গায় আছে। আমি এটিকে শুধু ফিশারিই নয়, ‘অ্যাগ্রো’তে টার্ন করাচ্ছি। আমি এর পাশাপাশি ডেইরিও করছি। আমি গ্রামের ছেলে, মাটির প্রতি আমার একটি টান আছে। তাছাড়াও আমি সিনেমা বানাতে চাই। প্রডিউসাররা তো নিজের কথা বলতে চায়, আর ঘোরায়। কিন্তু আমি তো আমার গল্প বলতে চাই। প্রোডিউসারদের সঙ্গে আমার বেসিক পার্থক্য হচ্ছে- তাঁদের টাকা আছে, আমার টাকা নেই। অর্থাৎ আমার নিজের গল্প দিয়ে সিনেমা বানানোর মধ্যেখানের দেওয়ালটি হচ্ছে- ‘টাকার দেওয়াল’। আমি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করে টাকা উপার্জনের চেষ্টা করেছি। নানান কিছু ট্রাই করেছি। কারণ আমার সিনেমা বানানোর ইচ্ছা আমাকে পূরণ করতে হবে। তখন আমার মনে হলো- আমাকে এক্সট্রা ইনকামের পথ বের করতে হবে। তাই আমি ফিশারী ব্যবসা শুরু করি, এবং আমি নিশ্চিত যে সেখান থেকে টাকা আসবে। আমি সেই টাকা দিয়ে সিনেমা বানাব।
শরাফ আহমেদ জীবন। ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল; প্রিয়.কম।
প্রিয়.কম: কিন্তু সবাই তো আপনার মতো ফিশারী ব্যবসায় উপার্জিত টাকা দিয়ে সিনেমা বানাতে পারবে না। সেক্ষেত্রে তারা কী করবে?
শরাফ আহমেদ জীবন: আমি যেই ওয়েতে (ফিশারীং) অর্থ উপার্জন করে সিনেমা বানাতে চাইছি- এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যা হোক, সিনেমা কিংবা নাটক বানানো যেহেতু আলাদা শিল্প মাধ্যম সেহেতু এখানে প্রফেশনাল ইনভেস্টরই থাকা উচিত। এখন অবশ্য প্রফেশনাল ইনভেস্টররা এগিয়ে আসছেন। এছাড়াও- আয়নাবাজির সিরিজ হচ্ছে, এদিকে ‘ছবিয়াল রিইউনিয়ন’ হলো- এটা কিন্তু এই শিল্পে পজেটিভ একটি ভাইব।
প্রিয়.কম: ইন্ডাস্ট্রির কিছু নেগেটিভ ভাইবও তো রয়েছে...
শরাফ আহমেদ জীবন: ইন্ডাস্ট্রি খারাপ হওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে কনটেন্টের অভাব। আপনি যদি ভালো কিছু না দিতে পারেন, তাহলে মানুষ তা দেখবে না। ‘ভালো কিছু’র চেয়েও ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে ‘নতুন কিছু’। কোয়ান্টিটির চেয়েও কোয়ালিটির দিকে বেশি নজর দিতে হবে। কমার্শিয়াল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিলে চলবে না।
প্রিয়.কম: ‘ছবিয়াল রিইউনিয়ন’এর ফলাফল আমরা কবে নাগাদ দেখতে পাব?
শরাফ আহমেদ জীবন: যতদূর আমি জানি, অবশ্য আমার জানা ভুলও হতে পারে- এই দুই ঈদ মিলে ১২ টি ফিকশন হবে। মানে কোরবানির ঈদ ও রোজার ঈদ মিলে। এরপর ১২ টি ছবি হবে। এটা ডিক্লিয়ার্ড। ইন্ডাস্ট্রিতে একটা মেসিভ চেঞ্জ আসবে। দুই ঈদে ১২ টি নাটক হওয়া মানে- ১২ টি গল্প পাওয়া। ১২ টি নতুন গল্প পাওয়া। সবচেয়ে বড় চেঞ্জ যেটা হবে, সেটা হচ্ছে- ১২ টি সিনেমা হবে, যা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড একটা রেভ্যুলেশন ঘটিয়ে দেবে।
প্রিয়.কম: নতুন পুরাতন মিলিয়ে ১২ জনের গল্প?
শরাফ আহমেদ জীবন: না, আমাদের এক সময়কার ১২ জন। ছবিয়ালে তো এরপর আরও অনেকে এসেছেন। এর সংখ্যা বাড়তেও পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা ১২ টিই জানি। কিন্তু সেটা বাড়বে, সেটা কমবে না। আমার মনে হয় মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর এই উদ্যোগটিকে অনেকে ফলো করবে। এটি ফলো করার মতোই উদ্যোগ।
প্রিয়.কম: বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপনার ভাবনায় বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনসমূহ এখন কতটা মান সম্মত?
শরাফ আহমেদ জীবন: বিজ্ঞাপন কমিউনিকেশনের একজন মানুষ হিসেবে আমি বলব- বিজ্ঞাপনের মান গত কয়েক বছরে অনেক ডেভেলপ করেছে। গত ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে বিজ্ঞাপন মেসিভলী পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু গত দুই থেকে তিন বছর যাবত আবার একই জায়গায় ঘোর-পাক খাচ্ছে! গত দু-তিন বছর ধরে আমরা খুব একটা এগোতে পারছি না। এর কারণ হিসেবে আমি মনে করি- এই সেক্টরেও লোকজন বেশি হয়ে গিয়েছে। এখানেও কোয়ান্টিটি বাড়ছে, কোয়ালিটি বাড়ছে না। অবশ্য এই খাতে কিছু সুখবরও রয়েছে। গতবার ইনোভেশনে ‘গ্রে’ কান’স অ্যাওয়ার্ড পেল, এবার তানভির ভাইয়ের সান-কমিউনিকেশনের একটি কাজ কানস’এ গেল। মানে কিছু পজেটিভ দিক রয়েছে। কিন্তু গড়পরতায় খুব বেশি ডেভেলপ হচ্ছে না। ভালো কিছু হচ্ছে কিন্তু নতুন কিছু হচ্ছে না। আমাদের নতুন কিছু করা দরকার।
প্রিয়.কম: বিজ্ঞাপন নির্মাণে আবেগকে পুঁজি করা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
শরাফ আহমেদ জীবন: আসলে পথ তো কম। হয় আপনি কাঁদাবেন অথবা আপনি হাসাবেন- এই দুয়ের মধ্যে দিয়েই তো বিজ্ঞাপন তৈরি করতে হয়। এছাড়া তো আর কোনো রাস্তা নেই। তা ছাড়াও আমাদের দেশের মানুষ এ দুটি জিনিসই পছন্দ করে।
প্রিয়.কম: আজকাল বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মিশ্রণ...
শরাফ আহমেদ জীবন: দেখুন, অ্যাডভারটাইজমেন্টের কাজ কি জানেন? সময়ের সঙ্গে যে ট্রেন্ড যখন চলে, বিজ্ঞাপন তখন সেটিই অনুসরণ করে। যখন সোসাইটিতে যা চলছে তখন সেটাই অনুকরণ করার চেষ্টা করবে বিজ্ঞাপন। এটা অ্যাডভারটাইজিং এর দোষ নয়, তারা সময়কে ধারণ করছে। মানে টাইপটাই এরকম! আমি যখন রেডিও শুনি, তখন আমার হাসি পায়। ইচ্ছা করে রেকর্ড করে ওদের কথাই ওদের যদি শোনাতে পারতাম!
প্রিয়.কম: সিনেমা বানাবেন না?
শরাফ আহমেদ জীবন: আমি নীতিগত ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি- আমি অন্য কোনো প্রোডিউসারের টাকা দিয়ে সিনেমা বানাব না। আমি আমার নিজস্ব অর্থায়নে করব। তবে যদি ছবিয়াল থেকে হয়, তাহলে আমি সিনেমা বানাব। কারণ ছবিয়াল থেকে যদি হয়, তাহলে সেটা হবে যথেষ্ট প্রফেশনালভাবে। সেখানে আমার কন্টেন্ট এবং আমার গল্পকেই মূল্যায়ন করা হবে।
প্রিয়.কম: আপনার বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?
শরাফ আহমেদ জীবন: আমি প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি কাজ করে থাকি গ্রে-এর, মানে গাউসুল আজম শাওন ভাইয়ের। এখন বিজ্ঞাপন নির্মাণ নিয়েই ব্যস্ত আছি।
প্রিয়.কম: কিসের বিজ্ঞাপন?
শরাফ আহমেদ জীবন: সেটা বলা যাবে না। বিজ্ঞাপনের বিষয় তো, একটু ঝামেলা থাকে। তবে আমার হাতে সামনে অনেকগুলো বিজ্ঞাপনের কাজ আছে।
প্রিয়.কম: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
শরাফ আহমেদ জীবন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ প্রিয়.কমকে।
সম্পাদনা: কুদরত উল্লাহ