ছবিটি প্রতীকী, ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত।

বোকা মেয়ের ডায়েরি: ডিভোর্সি মেয়ে এঁটো, বয়স্কা মেয়ে বাসি!

রুমানা বৈশাখী
বিভাগীয় প্রধান (প্রিয় লাইফ)
প্রকাশিত: ০৪ জুন ২০১৮, ০০:৪১
আপডেট: ০৪ জুন ২০১৮, ০০:৪১

শিরোনাম পড়ে অনেকেরই মনে হতে পারে যে আমি কেবল পুরুষদের কথাই বলছি। হ্যাঁ, পুরুষদের কথা তো বলছি বটেই, একইসাথে কিছু নারীদের কথাও বলছি। দেশ এগিয়ে গেছে, এখন অনেক মেয়েই গৃহ নির্যাতন না সয়ে ডিভোর্সের প্রস্তুতি নেয়। মনের মিল না হলে বা পরকীয়ার ক্ষেত্রে অতীতে যেখানে মুখ বুজে সংসার করাই নিয়ম ছিল, এখন তা বদলেছে। এখন অনেকেই ঘুণে ধরা সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তবুও, আসলেই বেরিয়ে আসে কি? এই সমাজ কি সত্যিই বেরিয়ে আসতে দেয়? নাকি ব্যাপারটা জ্বলন্ত কড়াই থেকে উনুনে ঝাঁপ দেয়ার মতোই?

আমরা মানতে চাই বা না চাই, আমাদের সমাজে এখনও নারীর জীবন ঘুরেফেরে বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনটির আশেপাশে। যৌবনে পা দিতে না দিতেই লোকের যেন একটাই মাথা ব্যথা- এই মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না কেন? বয়স একটা নির্দিষ্ট সীমা পার করে ফেললে এখনো আর মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা এগোয় না। ত্রিশের পর বিয়ে করা মেয়েদের দিকে আজও অন্যভাবেই তাকায় সমাজের বেশীরভাগ মানুষ। পরিবারের কপালে ভাঁজ পড়ে, বাচ্চা হবে কি হবে না তা নিয়ে গবেষণা করে আত্মীয়স্বজনে, পাত্রপক্ষ মনে মনে ভাবে- “এতদিনেও বিয়ে হয়নি! মেয়ের আবার কোন সমস্যা নেই তো?”

অন্যদিকে ডিভোর্সি হলে যেন কথাই নেই। প্রথমত, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিজের পরিবারই বাঁধা দেয় ডিভোর্সে। চিন্তা থাকে কেবল ওই একই- ডিভোর্সের পর কে নেবে মেয়ের দায়িত্ব? কোনক্রমে যদি ডিভোর্সের গণ্ডি পার হয়েও যায়, তখন শুরু হয় আরও বড় মাথা ব্যথা- কে করবে এই ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে? ডিভোর্সি পুরুষের বিয়ে নিয়ে খুব একটা ভাবে না কেউই, কিন্তু ডিভোর্সি মেয়ের বিয়ে হয়ে দাঁড়ায় দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ। মা-বাবা-ভাই-বোন ভাবে, পাড়া-পড়শি ভাবে, আত্মীয়-স্বজন চিন্তায় ঘুমাতে পারে না। অমুক বাসার আংকেল আর পাড়ার মোড়ের দোকানদার, অফিসের কলিগ কিংবা ফেসবুকের বন্ধু- সকলের ভাবনা কেবল ওই একই।

এই ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করবে কে? কেন করবে?

একজন পুরুষ যেখানে তালাকের পরেও অবিবাহিতা কোন নারীকে বিয়ে করতেই পারেন, সেখানে ডিভোর্সি মেয়ের জন্য অবিবাহিত পুরুষ যেন কল্পনাই করা যায় না। ডিভোর্সি মেয়ের বিয়ে হবে ডিভোর্সি পুরুষের সাথে, বড়জোর স্ত্রী মারা গেছেন এমন কারো সাথে। এমনকি একাধিক স্ত্রী আছে এমন কারো সাথে বিয়ে দিতেও আপত্তি থাকে না কারো। কেন? কেন আবার, ডিভোর্সি মেয়ে যে এঁটো! তাঁকে অন্য পুরুষ ছুঁয়েছে, অন্য পুরুষ ভোগ করেছে। এখন যে কেউ নিতে চাইছে, সেটাই তো বেশি। এর বাইরে নারী আর চায়টা কী? ডিভোর্সি মেয়ের ভালবাসবার অধিকার নেই, স্বপ্ন দেখবার অধিকার নেই, অতীতের কষ্ট ভুলে নতুন করে বাঁচার অধিকারও নেই। কোন অবিবাহিত পুরুষ যদি ভুলে ডিভোর্সি নারীকে ভালোবেসেও ফেলেন, সমাজ ও পরিবারবর্গ তখন হা হা করে তেড়ে আসে- ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে? বলি, দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে?

কেবল ডিভোর্সি মেয়ের কথা কেন বলি, ৩৫+ অবিবাহিত নারীর ক্ষেত্রেও এমনটাই ভাবে লোকে। নারী শিক্ষিত তো কী হয়েছে, স্বাবলম্বী তো কী হয়েছে। কোনক্রমে একটা বিয়ের প্রস্তাব পেলেই হলো। পাত্র যেমনই হোক না কেন, বয়স্কা মেয়ে যে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এটাই ঢের বেশি। বয়স্কা মেয়ে তো বাসি, বসন্ত পার হওয়া ফুলের মতন। বাসি ফুল দিয়ে কি দেবতার পুজা হয়? স্বামী তো দেবতাই। দেবতার পায়ে চড়ে সদ্য ফোটা তাজা ফুল। আর তাই তো আজও ৩৫+ পাত্রের জন্যে পরিবার থেকে খোঁজা হয় কলেজ পড়ুয়া বধূ। আর তাতে সমাজের কেউ কোন অসঙ্গতিও দেখতে পান না। কেবল পাত্রের দোষ দিয়ে লাভ নেই, পাত্রের পরিবার কিংবা পাত্রীর আত্মীয়-স্বজনেরও এতে কম আগ্রহ থাকে না। পাত্রের ডিভোর্সি কিংবা অবিবাহিতা বোনটিও দেখা যায় ভাইয়ের জন্য ঠিক ঠিক কুমারী কচি মেয়ে খোঁজে।

কেন এই হিপোক্রেসি, আমার জানা নেই। কীভাবে এসব বদলাবে, জানা নেই সেটাও। আজ আমি বরং বিনিময় করবো কিছু অভিজ্ঞতা। কিছু ভুক্তভোগী নারীর বয়ান, যাদের সাথে বিভিন্ন সময়ে আমার আলাপ হয়েছে। অনুমতি সাপেক্ষেই কথাগুলো প্রকাশ করা হলো, নামগুলো কেবল বদলে দিলাম। বাকিটা পাঠকের বিবেচনা।


মুক্তা (বয়স ৪২, ব্যাংকার)

আজীবন স্বপ্ন দেখে এসেছি বিয়ে করবো, সংসার হবে আমার। জানি এই বয়সে বিয়ে হওয়া কঠিন, কিন্তু আমি সন্তানের স্বপ্ন ছাড়তে পারি না। কিছুদিন আগেই পরিবার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে প্রস্তাব নিয়ে এলো। ভদ্রলোকের স্ত্রী গত হয়েছেন, বয়স ৫০। প্রথম দিন ফোন করেই জানতে চাইলেন আমার ওজন কত আর আমি কুমারী কিনা!

ফারজানা (বয়স ৩০, শিক্ষিকা)

আমার ডিভোর্স হয়েছে আজ ২ বছর। সারাক্ষণ কেবল একই কথা শুনি- বিয়ে কবে করবে, বিয়ে কবে করবে? সহপাঠীর সাথে ডিভোর্সের পর মন দেয়া-নেয়া হয়েছিল কিছুদিন। কিন্তু তার মা জানিয়ে দিলেন, এই মেয়ে অন্য লোকের সাথে শুয়েছে, এই মেয়ে বিয়ে করা যাবে না। হ্যাঁ, তিনি ঠিক এটাই বলেছেন।

শ্রাবণী (বয়স ২৮, সাংবাদিক)

আমার বাসা থেকে ক্রমাগত বিয়ের চাপ। দিনরাত সারাক্ষণ। কোথাও গিয়ে নিজের মত থাকবো, সে উপায় নেই। কাজিনদের সব বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, আমার মা-বাবা মনে করেন ৩০ পার হলে আমার আর বিয়েই হবে না। বন্ধুরা বলে ত্রিশের পর ভালো সম্বন্ধ পাব না, এখন যা পাচ্ছি তাতেই যেন রাজি হয়ে যাই। আচ্ছা, মনের মিল না হলে বিয়ে কেন করবো? কেবল পাত্রের ফ্যামিলি আর চাকরি দেখেই কি বিয়ে করে ফেলা যায়?

আতিয়া (বয়স ৩৭, ব্যাংকার)

ডিভোর্সের ৩ বছর পর খুব স্বপ্ন নিয়ে সংসার শুরু করেছিলাম। প্রেম করেই বিয়ে হলো, স্বামী সবই জানতেন। তার পরিবারও জানতো। চারটে বছর খুব ভালোই ছিলাম, এরপর দেখতে পেলাম বাস্তবার আসল রূপ। বর জড়িয়ে গেলেন পরকীয়ায়, ফেসবুকের মাধ্যমে। আমার শরীর নাকি নোংরা হয়ে আছে অন্য পুরুষের স্পর্শে, তার ঘেন্না লাগে। আবারও ডিভোর্স হলো। শুনেছি সে বিয়েও করেছে। স্ত্রীর বয়স ২২। আর আমি দ্বিতীয় ডিভোর্সের কারণে একপ্রকার জীবনচ্যুত হয়ে বেঁচে আছি। পরিবারের কথা বাদই দিলাম, অফিসের কানাঘুষাতেও টেকা দায়। সকলে আমারই দোষ খোঁজে। কিন্তু আমি তো কিছুই গোপন করিনি!

রূম্পা (বয়স ৩৫, উদ্যোক্তা)

হ্যাঁ, আমার বিয়ে হয়নি। আমার নিজের ইচ্ছাতেই হয়নি। এমন নয় যে আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু তাড়াহুড়ায় একজন ভুল মানুষকে বিয়ে করে পস্তাতে চাই না। কিন্তু এই কথাটা কেউ বোঝে না। নিজের ভাই-বোনেরাও এখন পাশে নেই। ছোট বোন, বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা কথায় কথায় বলবে- তোমার তো সংসার নেই, তুমি কী বুঝবে! একজন নারীর জন্যে সংসার থাকাই কি সব। লোকে কানাঘুষা করে এই বলে যে নিশ্চয়ই আমি বন্ধ্যা, তাই বিয়ে হয় না!

শেষ কথা-
দিন বদলেছে, কিন্তু মানুষ বদলেছে কি? মানুষের ভাবনা বদলেছে কি? বিশেষ করে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে এখনও আসন গেড়ে বসে আছে প্রাচীন সব ধারণা যা আজকের পৃথিবীতে অচল। নারীর প্রতি সহিংসতা, গৃহ নির্যাতন বন্ধের প্রতিবার আমরা সবাই করি। কিন্তু জানেন কি, সেই প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না, যদি না আমরা বদল করতে পারি নিজের ধ্যান-ধারণা। ডিভোর্সের হার কমে যাক, আমরা সকলেই চাই। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব, যখন দুটি মানুষকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হবে নিজেদের দাম্পত্য শুরু করার।

জীবনের জন্য বিয়ে জরুরী অবশ্যই। কিন্তু সেটার অর্থ এই নয় যে বিয়ে না করলেই নারীর জীবন বৃথা। জীবনের জন্য সংসার, সন্তান জরুরী বটে, কিন্তু সেটার অর্থ এই নয় যে ডিভোর্সি নারীকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে হবে।

সবচাইতে বড় কথা-
বয়স বেড়ে গেলে পুরুষের শরীর যদি বাসি না হয়, নারীর শরীর কেন হবে?
ডিভোর্স হলে পুরুষের শরীর যদি এঁটো না হয়, নারীর শরীর কেন হবে?

দৃষ্টিভঙ্গি বদল করুন, জীবন বদলে যাবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও তরুণ উদ্যোক্তা। প্রিয়.কমে নিয়মিত ব্লগ লিখছেন ‘বোকা মেয়ের ডায়েরি’ শিরোনামে।

[প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ লেখকের ব্যক্তিগত। এর সাথে প্রিয়.কমের সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে]