
পদচারী সেতুগুলোতে দিন ও রাতে এভাবে শুয়ে থাকে ভিক্ষুক ও পথশিশুরা। ছবি: সংগৃহীত
পায়ের দেখা ‘পায় না’ পদচারী সেতু
আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২১:৫৩
(প্রিয়.কম) সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার অভাবে ঢাকার ফুটওভার ব্রিজ তথা পদচারী সেতুগুলোর বেশির ভাগই কাজে আসছে না। নিতান্ত বাধ্য না হলে এগুলো ব্যবহার করেন না পথচারীরা। এমন বাস্তবতায় অপ্রয়োজনীয় স্থানে ও অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত বেশ কিছু পদচারী সেতু স্থানান্তরের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
নগরবিদদের মতে, নানা জটিলতা ও চলাচল কষ্টকর হওয়ায় সেতুগুলো রেখে যানবাহনের মধ্য দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হন পথচারীরা। ফলে বহু অর্থ খরচ করে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ লাগানো ও ব্যবহারে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেও আসছে না সফলতা; বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের (আইএবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের অধিকাংশ পদচারী সেতু সঠিক নিয়মে নির্মিত হয়নি। ৯৯ শতাংশই নির্মিত হয়েছে ভুল জায়গায়। এগুলোর উচ্চতাও অনেক বেশি। একই সঙ্গে সিঁড়ির ধাপগুলো আনুপাতিকভাবে সঠিক নয়। দেখতেও ভালো লাগে না। কোনো বয়স্ক মানুষকে পদচারী সেতু ব্যবহার করতে হলে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এর ফলে মানুষ এগুলো ব্যবহার করছে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) বলছে, সিটি করপোরেশনগুলো সুপরিকল্পিতভাবে অনেক কাজই করে না। কোন কোন স্থানে পদচারী সেতু দরকার, আবার কোন স্থানে জেব্রা ক্রসিং করা দরকার, তা নিয়ে কার্যকর গবেষণা করা হয়নি। এ নিয়ে পথচারী ও পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। দরকার পরিকল্পনারও। তা না করে অপ্রয়োজনীয় স্থানে সেতু নির্মাণ করলে তা ব্যবহার করবে না জনগণ।
দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীতে ৮৭টি পদচারী সেতু রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ৩২টি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৪৯টি। এগুলো ছাড়াও ডিএনসিসির আওতায় সড়ক ও জনপথের (সওজ) পাঁচটি ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) একটি পদচারী সেতু রয়েছে।
ডিএনসিসিতে আরও দুটি সেতু নির্মাণাধীন। আর নির্মাণের পরিকল্পনায় আছে আরও তিনটি।
দুই সিটি সূত্রে জানা যায়, এসব সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ২০০ কোটি টাকার বেশি।
কোন পদচারী সেতু কোথায়
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, তাদের আওতাধীন পাঁচটি অঞ্চলে ৩২টি পদচারী সেতু রয়েছে। এগুলো কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড, সায়েন্সল্যাব মোড়, নিউমার্কেট, শাহবাগ (বিএসএমএমইউ হাসপাতাল এবং বারডেমের লিংক সেতু), শাহবাগ (বারডেম ও শিশুপার্ক), শাহবাগ (এলিফ্যান্ট রোড), রমনা আইইবির সামনে, কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে, কার্জন হল (কলেজ রোড), বাংলামোটর, শুক্রাবাদে মেট্রো শপিং মল (মিরপুর রোড), সোবহানবাগ মসজিদ, ল্যাব এইড হাসপাতাল, বসুন্ধরা শপিং মল, বেইলি রোড অফিসার্স ক্লাব, পরীবাগ, সাত মসজিদ রোড, জাতীয় প্রেসক্লাব, পল্টনে বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশে, মুগদাপাড়া জনপথ সড়ক, জনপথ রোড (বাসাবো), কমলাপুর, মতিঝিল বয়েজ স্কুল, মতিঝিল শাপলা চত্বর, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল, নটরডেম কলেজের সামনে, আজিমপুর গার্লস স্কুল, সোনারগাঁও রোড (বুয়েট), নর্থসাউথ রোড, সুরিটোলা হাইস্কুলের সামনে, সদরঘাট বাংলাবাজার মোড়, হোটেল ইলিসিয়াম (হাটখোলা রোড) ও জুরাইনে অবস্থিত।
উত্তর সিটি করপোরেশনের পদচারী সেতুগুলো মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার আবুল হোটেল, রামপুরা টিভি সেন্টার, মধ্য বাড্ডা, উত্তর বাড্ডার ক্যামব্রিয়ান কলেজ, নতুনবাজার, নর্দা, ঢাকা পলিটেকনিক, তেজগাঁও কহিনুর কেমিক্যাল, মহাখালী আইসিডিডিআরবি, বনানী রোড-১১, কাকলী, তিতুমীর কলেজ, গুদারাঘাট (লিংক রোড), বাংলা মোটর ক্রসিং, কারওয়ানবাজার (ডেইলি স্টার), ফার্মগেট (হলি ক্রিসেন্ট), ফার্মগেট (পুলিশ বক্স), কলমিলতা বাজার, পুরাতন বিমানবন্দর, বিএএফ শাহীন কলেজ, শ্যামলী, কল্যাণপুর, দারুস সালাম (টেকনিক্যাল), মিরপুর বাংলা কলেজ, মিরপুর-১, মিরপুর-২ (ক্রিকেট স্টেডিয়াম), মিরপুর-১০, মিরপুর-১৩, মিরপুর-১৪ পুলিশ স্কুল, কাজীপাড়া, আনন্দ সিনেমা হল, শেওড়াপাড়া (মনিপুর স্কুল), আনোয়ার গার্লস স্কুল (দক্ষিণ), আনোয়ার গার্লস স্কুল (পূর্ব), আদমজী কলেজ, গ্যারিসন সিনেমা, ক্যান্টনমেন্ট (সিএমএইচ), জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের পশ্চিম পাশে, নতুন খিলক্ষেত ক্রসিং, কুড়িল ফ্লাইওভার, খিলক্ষেত, কাওলা, নতুন বিমানবন্দর ক্রসিং, স্কলাস্টিকা স্কুল, উত্তরার রাজলক্ষ্মী, আজমপুর, রাজউক কলেজ, হাউস বিল্ডিং, আব্দুল্লাহপুর ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পাশে নির্মিত হয়েছে।
মিরপুরের রজনীগন্ধা মার্কেট, একই এলাকার আবু তালেব স্কুলের পাশে ও শিশুমেলায় তিনটি পদচারী সেতু নির্মাণাধীন।

পদচারী সেতুর বেশ কয়েকটিতে ঘুরে দেখা যায়, এগুলোর অধিকাংশ ব্যবহার হয় না। রাস্তা পারাপারের চাপ আছে এমন স্থান থেকে সেতুগুলো অনেক দূরে। কয়েকটিতে ভিক্ষুক ও পথচারীরা শুয়ে আছে। চলছে ভিক্ষাবৃত্তি।
বেশ কয়েকটিতে নেই রাতে আলোর ব্যবস্থা। এগুলো সঠিকভাবে দেখভালও করা হচ্ছে না। বেশ কয়েকটিতে ফুলগাছ লাগানো হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশই মরে গেছে। হাতে গোনা কয়েকটি সেতু রাস্তা পারাপারের চাহিদা রয়েছে, এমন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বসুন্ধরা সিটির সামনের সড়কে স্থাপিত পদচারী সেতু দিয়ে পথচারীদের পারাপার নেই বললেই চলে। তারপরও অপ্রয়োজনীয় এ সেতুটি দীর্ঘদিন টিকে আছে। বেইলি রোড অফিসার্স ক্লাব পদচারী সেতুতে গিয়েও দেখা যায় একই অবস্থা। এই সেতুটিও ব্যবহার হচ্ছে না।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পদচারী সেতু দিয়ে রাস্তা পারাপারে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের ভাষ্য, যেসব পদচারী সেতু ব্যবহার করা হচ্ছে না কিংবা নির্ধারিত স্থান থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে, সেগুলো স্থানান্তর করে সঠিক স্থানে স্থাপন করা হবে। আর ব্যবহার হওয়া সেতুগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করা হবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ কাজ শুরু করা হবে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এতে কী পরিমাণ ব্যয় হবে, তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী খান মোহাম্মদ বিল্লাল প্রিয়.কমকে বলেন, ‘দুই-একটি জায়গায় ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার হচ্ছে না কিংবা ইতোপূর্বে অপ্রয়োজনীয় স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো স্থানান্তর করে প্রয়োজনীয় ও লোক সমাগমপূর্ণ স্থানে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় রমনা থানার সামনেসহ ছয়-সাতটি স্থানে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে। তবে কোনো ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী মেজবাহুল ইসলাম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা ফুটওভার ব্রিজগুলো ব্যবহারের উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছি; দৃষ্টিনন্দন করে সাজানোর চেষ্টা করছি। মেট্রোরেল বা নানা কারণে দুই-চারটি ফুটওভার ব্রিজ স্থানান্তর করতে হবে। পথচারীদেরকে সচেতন করার পাশপাশি ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে।’

পরিবেশ বাঁচাও (পবা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘দুই-একটি ফুট ওভারব্রিজ হয়তো স্থানান্তরের প্রয়োজন আছে। তবে যা আছে, তাও অপরিকল্পিতভাবে হয়েছে। পথচারী ও যানবাহনের চলাচলের অসুবিধা না করে ফুট ওভারব্রিজ দিতে হবে। সৎ উদ্দেশ্য থাকতে হবে। স্বেচ্ছাসেবী রাখতে হবে।’
‘বড় বড় কথা বলে লাভ নেই। রাজনৈতিক নেতাদেরকে আগে পথচারী হয়ে হাঁটতে হবে। তবেই তারা সমস্যা বুঝবেন। তবে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বলতে পারেন, সেটা জলেই গেছে।’
‘পথচারীদের সর্বোচ্চ অধিকার নীতি’ বাস্তবায়ন করারও আহ্বান জানান আবু নাসের।
প্রিয় সংবাদ/হাসান