আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এ উপলক্ষে প্রিয়.কম এর সাপ্তাহিক আয়োজন ‘একজন মানুষের গল্প’-এ আজ থাকছে দু’জন মানুষের এক হওয়ার গল্প।
ফিল্ড ওয়ার্কের ফাঁকে সামনে সংসদ ভবন পড়ে যাওয়ায় একটু বিশ্রাম নিতে, জীবনের কিছু অমীমাংসিত হিসেব মেলাতে ছায়ায় বসেছি তখন। সংসদ ভবনের সামনের এলাকাটা তখন জনারণ্য। এক, পহেলা ফাল্গুনের রেশ এখনো কাটেনি; দুই, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এবং তিন, আজ ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সবমিলিয়ে ভালোবাসার পাখিদের জন্য দিনটা বলতে গেলে আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার মত।
কিন্তু বেশিক্ষণ জীবন ভাবনায় মেতে থাকা গেল না। কাছেই বসে থাকা জুটির খুনসুটির ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল আমার হৃদয় বন্দরে। খুব সম্ভবত ‘সাংবাদিক’ লেখা বোর্ড লাগানো আছে আমার বুকে-পিঠে, যা আমি ছাড়া বাকি সবাই দেখতে পায়। জুটির ছেলেটা একটু পর আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই কি সাংবাদিক?’
আমার হ্যা-সূচক উত্তর দিয়ে শুরু হল কথপোকথন। জমে উঠল গল্প। ক্রমে ক্রমে আমার সামনে উন্মোচিত হল সাধারণ দু’টো মানুষের অসাধারণ গল্প।
দু’জনের বাড়িই মফস্বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে ঢাকায় আগমণ। পরিচয়ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিষয়ে পড়ার কারণে। ভিন্ন এলাকার ভিন্ন ধর্মের মানুষ ওরা- হয়তো দু’টো জীবনের গল্পও ভিন্ন হতে পারতো। কিন্তু ‘ভালোবাসা’ নামক অদৃশ্য শক্তিধর আবেগ দু’টো জীবনের গল্প এক করে ফেলেছে। শোনার সময় মনে হচ্ছিল, মুক্তমনের অধিকারী কোনো গুণী পরিচালক নির্মিত কোনো চলচিত্র দেখছি!
নিজেদের কাহিনী বলতে বলতে ছেলেটা বলল, ‘ওকে আমি প্রথম দেখি ডিপার্টমেন্টে। আমার এক ইয়ার জুনিয়র। দেখেই প্রেমে পড়ে যাই। বলতে পারেন, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।’ কথা শেষ করতেই হেসে উঠল ছেলেটা। মেয়েটার চোখেমুখে খেলে গেল লজ্জা।
মেয়েটা যোগ করল, ‘প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বুঝে গেছি ও আমাকে ফলো করছে। নিজেকে ঠিকভাবে লুকাতে পারে না ও। ভেতরের আবেগ সবসময়ই চেহারায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।’
তারপরের ঘটনা বলতে গিয়ে ছেলেটা বলল, ‘আমার ভেতর ওর সাথে কথা বলার তাড়না এমনভাবে সৃষ্টি হল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই মুশকিল হয়ে পড়ল। একদিন সরাসরি সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম।’ হয়তো ছেলেটার কথায় নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হল মেয়েটা। ঠোঁটে প্রশ্রয়মাখা হাসি নিয়ে আপন মনে বলে উঠল, ‘প্রথম সামনে দাঁড়িয়েই সে বলে বসল, আপনি খুব সুন্দর। অন্য কোনো মেয়ে হলে কী করতো জানি না, কিন্তু ওর সেদিনের আবেগ, চেহারার অভিব্যক্তি আমাকে জাদু করেছিল!’

এঘটনার পর থেকেই টুকটাক কথা হত সামনে পড়লেই। পরিচয়ের পর প্রায় একমাস পেরিয়ে যাওয়ার পর নিজেদের ধর্মের ভিন্নতার কথা অবগত হয় ওরা। বেশিরভাগ মানুষের নামেই ধর্মের পরিচয় উঠে আসে কিন্তু মেয়েটার নাম এমন, বোঝার উপায় নেই, সে হিন্দু, নাকি মুসলিম, না খ্রিষ্টান! সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ছেলেটা বলল, ‘সেদিন কী যে কষ্ট হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, কেউ বুকের পাঁজরের হাড় একটা একটা করে ভাঙছে!’
মেয়েটা তো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, আর নয়। অনেক হয়েছে, এবার ইউ-টার্ন করতে হবে। কিন্তু দু’জনের বুকে দানা বেঁধে ওঠা ভালোবাসার শক্তি সম্পর্কে ওদের ধারণা ছিল না। ভালোবাসাই ওদের ধরে রাখল একই পথে। নিজেদের ধর্মের ব্যাপারে সচেতন থাকলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না।
দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর ঘুরল। মেয়ের বাড়ি থেকে খবর এল, বিয়ে ঠিক হয়েছে তার। মাথায় যেন বাজ পড়ল দু’জনেরই। দু’জনেই ছুটল নিজ নিজ বাড়ি, নিজেদের আবেগ প্রতিষ্ঠায়। ছেলের পরিবার শেষ পর্যন্ত রাজি হলেও শর্ত জুড়ে দিল, মেয়েকে ধর্মান্তরিত হতে হবে। কিন্তু মেয়ের পরিবার কিছুতেই রাজি না। এক, ছেলে ভিন্ন ধর্মের; দুই, ছেলে তখনো ছাত্র। মেয়েকে জোর করে ধরে সেবারই এংগেজমেন্ট করিয়ে দেওয়া হল। বিয়ের দিন নির্ধারিত হল ঠিক তিনমাস পর।
মঙ্গল চিন্তা করে ঢাকা ফিরে ওরা দু’জন আলোচনা করেই ঠিক করল, আর নয়। এবার পথ ভিন্ন হতেই হবে। ভালোবাসার দেবী হয়তো তখনো মুচকি হাসলেন ওদের সিদ্ধান্তে।
আস্তে আস্তে ঘণিয়ে এল বিয়ের দিন। বিয়ের তারিখের এক সপ্তাহ আগে এক প্রভাতে ছেলেটা মেয়ের সাথে কমলাপুর রেলস্টেশন গেল তাকে ট্রেনে তুলে দিতে। মেয়েটা ট্রেনে উঠল। একসময় ট্রেনের পরিচালক সবুজ পতাকা ওড়াতে শুরু করল। হর্ণ বাজিয়ে ট্রেনও সচল হয়ে উঠল।
সে সমযের কথা বলতে গিয়ে ছেলেটা বলল, ‘আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, ওই ট্রেনের নীচে পড়েই নিজের জীবন দিয়ে দেই। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর থেকে কেউ হৃদপিণ্ডটা টেনে-ছিড়ে বের করে নিয়ে আসছে!’
ট্রেনটা কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অশ্রুসজল চোখে তার চলে যাওয়া দেখছে ছেলেটা প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ মেয়েটার মুখ দেখা গেল ট্রেনের দরজায়। কষ্ট করে একটু হেসে হাত তুলতে যাচ্ছিল ছেলেটা বিদায় জানাতে। কিন্তু অবাক করা কাণ্ড। মেয়েটা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামল। ছুটে চলে এল ছেলেটার সামনে।
সেসময়ের কথা বলতে গিয়ে মেয়েটা বলল ‘ট্রেনটা যখন হর্ণ বাজিয়ে চলতে শুরু করল, আমার মনে হচ্ছিল, জীবনের অর্ধেকটা ফেলে চলে যাচ্ছি। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না নিজেকে। একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম, যা হওয়ার হবে; আমি বাড়ি যাব না, কোনোদিন না!’

তারপরের ঘটনা আরো রোমাঞ্চকর। দু’জনে বিয়ে করতে প্রথমে কাজী অফিস গেল কিন্তু ভিন্ন ধর্মের মেয়েটা ধর্মান্তরিত হতে নারাজ, অতএব কাজী ক্ষমা চেয়ে নিলেন। অপরদিকে মন্দিরের পুরোহিতও বিদায় করে দিলেন তাদের। উপায়ন্তর না দেখে কোর্টে গেল তারা। কিন্তু সেখানেও ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিয়ের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা উপস্থাপিত হল। শেষে ছেলেটার এক আইনজীবী বন্ধুর হস্তক্ষেপে আইনিভাবে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
বিয়ের পর মাস না পার হতেই দু’জনের পরিবারে সে খবর পৌঁছে গেল। হুলিয়া জারি করল মেয়ের পরিবার। থানায় একটা অপহরণ মামলাও করল। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে সে যাত্রা দু’জনেই বেঁচে গেল। কিন্তু মেয়ের পরিবার ছেলেকে পেলেই দেখে নেবে এক হাত- হুমকি দিয়ে রাখল। এদিকে ছেলের পরিবার তাকে ত্যাজ্য ঘোষণা করল। তখন এমন অবস্থা, পৃথিবীতে দু’জনের আপন বলতে শুধু ওরা দু’জনই।
ছেলেটা বলল, ‘এক বন্ধু আমাদের দু’জনকে ক’টা টিউশনি জোগাড় করে দিল। সে দিয়েই তখন একবেলা খেয়ে, দু’বেলা না খেয়ে কাটতে থাকল দিন। এভাবেই শেষ করলাম স্নাতক পর্ব।’
মেয়েটা অভিযোগের সুরে বলল, ‘ও আমাকে ভালো রাখতে অনার্স শেষ করেই চাকরিতে ঢুকে গেল। কিন্তু আমার অনার্স শেষে আমি যখন বললাম, আমিও চাকরি করবো, সে মানল না। ওর কারণে আমাকে মাস্টার্স করতে হল। অথচ নিজে আর মাস্টার্স করল না!’
ছেলেটা সরল হেসে বলে, ‘ভাই লেখাপড়া থেকে একবার সরে গেলে কি আর হয় তা?’
সবশেষে জানা গেল, তাদের পরম আত্মীয় বলতে এখনো তারা দু’জন। কারোর পরিবার মেনে নেয়নি এই অসম সম্পর্ক। ছেলে এবং মেয়ে নিজ নিজ ধর্ম থেকেও সরে দাঁড়ায়নি। দু’জনেই একই পরিবারে নিজ নিজ ধর্মের স্বকীয়তা বজায় রেখে দিব্যি আছে।
এমন সময় আমি বলে বসলাম, প্রিয়.কম এর পাঠকদের আজ তাদের গল্প শোনাব, কাজেই কয়েকটা ছবি তুলতে চাই। সাথে সাথে দু’জনেই প্রতিবাদ করে উঠল। ছেলেটা বলল, ‘ভাই, আমরা সাধারণ আছি, সাধারণই থাকতে দেন। যদি ওর বা আমার পরিবার আমাদের খুঁজে পায়, তাহলে বিপদ হবে আমাদের।’
একই আশঙ্কায় তারা তাদের গল্পের কথা উপস্থাপনে রাজি হলেও নাম প্রকাশ করতে রাজি হল না।
এই দু’জন ভালোবাসার পাখির নাম এবং ছবি না দিতে পারার জন্য প্রিয়.কম পাঠকদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।