
ছবি সংগৃহীত
হজের প্রকারভেদ এবং আপনি কোন হজ করবেন
আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০১৪, ১০:১৮
হজ তিনভাবে আদায় করা যায়, বা হব প্রধানত তিন প্রকার। এক. তামাত্তু। দুই. কিরান। তিন. ইফরাদ। ১. তামাত্তু হজ তামাত্তু হজের পরিচয় : হজের মাসগুলোতে হজের সফরে বের হবার পর প্রথমে শুধু উমরার ইহরাম বাঁধা এবং সাথে সাথে এ উমরার পরে হজের জন্য ইহরাম বাঁধার নিয়তও থাকা। শাওয়াল, যিলকদ ও জিলহজ এ তিনটি হল হজের মাস। হজের মাসসমূহে পৃথকভাবে প্রথমে উমরা ও পরে হজ আদায় করাকে তামাত্তু হজ বলে। অর্থাৎ ১ লা শাওয়াল থেকে উকুফে আরাফার পূর্বে (৯ জিলহজ), যেকোনো মুহূর্তে উমরা আদায় করে হালাল হয়ে যাওয়া ও উকুফে আরাফার পূর্বে নতুন করে হজের এহরাম বাঁধা। এবং হজের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করা। যারা হাদী সঙ্গে করে মক্কায় গমন করে না। বর্তমানে বহিরাগত হাজিদের কেউই হাদীর পশু সঙ্গে নিয়ে আসে না—তাদের জন্য তামাত্তু হজই উত্তম। কারও কারও মতে সর্বাবস্থায় তামাত্তু হজ উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ [সা.] বিদায় হজের সময় তাঁর সঙ্গে থাকা সাহাবাদের মধ্যে যারা হাদীর জন্তু সঙ্গে নিয়ে আসেননি তাদের সবাইকে তামাত্তু করার পরামর্শ দিয়েছেন, এবং নিজেও এই বলে কামনা ব্যক্ত করেছেন যে, যদি এ বিষয়টি পূর্বে প্রতীয়মান হত তাহলে হাদীর জন্তু সঙ্গে আনতাম না, আর যদি হাদী আমার সাথে না থাকত, তবে হালাল হয়ে যেতাম। তামাত্তু হজের নিয়ম : হাজী সাহেব হজের মাসগুলোতে প্রথমে শুধু উমরার জন্য তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে ইহরাম বাঁধবেন। তারপর তাওয়াফ ও সাঈ সম্পন্ন করে মাথা মু-ন অথবা চুল ছোট করার মাধ্যমে উমরা থেকে হালাল হয়ে যাবেন এবং স্বাভাবিক কাপড় পরে নেবেন। তারপর যিলহজ মাসের আট তারিখ মিনা যাবার আগে নিজ অবস্থানস্থল থেকে হজের ইহরাম বাঁধবেন। তামাত্তু হজ তিনভাবে আদায় করা যায় : ক) মীকাত থেকে উমরার ইহরাম বেঁধে মক্কায় গিয়ে তাওয়াফ-সাঈ করে মাথা মু-ন অথবা চুল ছোট করে হালাল হয়ে যাওয়া এবং হজ পর্যন্ত মক্কাতেই অবস্থান করা। ৮ যিলহজ হজের ইহরাম বেঁধে হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করা। খ) মীকাত থেকে উমরার নিয়তে ইহরাম বেঁধে মক্কা গমন করা। উমরার কার্যক্রম তথা তাওয়াফ, সাঈ করার পর হলক-কসর সম্পাদন করে হালাল হয়ে যাওয়া। হজের পূর্বেই যিয়ারতে মদীনা সেরে নেয়া এবং মদীনা থেকে মক্কায় আসার পথে যুল-হুলাইফা বা আবইয়ারে আলী থেকে উমরার নিয়তে ইহরাম বেঁধে মক্কায় আসা। অতপর উমরা আদায় করে হলক-কসর করে হালাল হয়ে যাওয়া; তারপর ৮ যিলহজ হজের জন্য নতুনভাবে ইহরাম বেঁধে হজ আদায় করা। গ) ইহরাম না বেঁধে সরাসরি মদীনা গমন করা। যিয়ারতে মদীনা শেষ করে মক্কায় আসার পথে যুল-হুলাইফা বা আবইয়ারে আলী থেকে উমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধা অতপর মক্কায় এসে তাওয়াফ, সাঈ ও হলক-কসর করে হালাল হয়ে যাওয়া। এরপর ৮ যিলহজ হজের ইহরাম বাঁধা। ২. কিরান হজ কিরান হজের পরিচয় : উমরার সাথে যুক্ত করে একই সফরে ও একই ইহরামে উমরা ও হজ আদায় করাকে কিরান হজ বলে। কিরান হজের নিয়ম : কিরান হজ দুইভাবে আদায় করা যায়। ক) মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধার সময় একই সাথে হজ ও উমরার ইহরাম বাঁধার জন্য (লাববাইকা উমরাতান ওয়া হজ্জান) বলে তালবিয়া পাঠ শুরু করা। তারপর মক্কায় পৌঁছে প্রথমে উমরা আদায় করা এবং ইহরাম অবস্থায় মক্কায় অবস্থান করা। অতঃপর হজের সময় ৮ যিলহজ ইহরামসহ মিনা-আরাফা-মুযদালিফায় গমন এবং হজের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা। খ) মীকাত থেকে শুধু উমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধা। পবিত্র মক্কায় পৌঁছার পর উমরার তাওয়াফ শুরু করার পূর্বে হজের নিয়ত উমরার সাথে যুক্ত করে নেয়া। উমরার তাওয়াফ-সাঈ শেষ করে ইহরাম অবস্থায় হজের অপেক্ষায় থাকা এবং ৮ যিলহজ ইহরামসহ মিনায় গমন ও পরবর্তী কার্যক্রম সম্পাদন করা। ৩. ইফরাদ হজ ইফরাদ হজের পরিচয় : হজের মাসগুলোতে শুধু হজের ইহরাম বেঁধে হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করাকে ইফরাদ হজ বলে। হজের মাসগুলোয় উমরা না করে শুধু হজ করাকে ইফরাদ হজ বলে। এ ক্ষেত্রে মীকাত থেকে শুধু হজের নিয়তে এহরাম বাঁধতে হয়। মক্কায় পৌঁছে তাওয়াফে কুদুম (আগমনি তাওয়াফ) করা। ইচ্ছা হলে এ তাওয়াফের পর সাঈও করা যায়। সে ক্ষেত্রে হজের ফরজ-তাওয়াফের পর আর সাঈ করতে হবে না। তাওয়াফে কুদুমের পর এহরাম অবস্থায় মক্কায় অবস্থান করা। ৮ জিলহজ একই এহরামে হজের কার্যক্রম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে মিনার দিকে রওয়ানা হওয়া। ইফরাদ হজকারীকে হাদী জবেহ করতে হয় না। তাই ১০ জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপের পর মাথা মু-ন করে ইফরাদ হজকারী প্রাথমিকভাবে হালাল হয়ে যেতে পারে। ইফরাদ হজের নিয়ম : হজের মাসগুলোতে শুধু হজের ইহরাম বাঁধার জন্য (লাববাইকা হজ্জান) বলে তালবিয়া পাঠ শুরু করা। এরপর মক্কায় প্রবেশ করে তাওয়াফে কুদূম অর্থাৎ আগমনী তাওয়াফ এবং হজের জন্য সাঈ করা। অতঃপর ১০ যিলহজ কুরবানীর দিন হালাল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকা। এরপর হজের অবশিষ্ট কাজগুলো সম্পাদন করা। ক্সতাওয়াফে কুদূমের পর হজের সাঈকে তাওয়াফে ইফাযা অর্থাৎ ফরয তাওয়াফের পর পর্যন্ত বিলম্ব করা জায়েয আছে। এছাড়া রয়েছে বদলি হজ যদি কোনো ব্যক্তি ফরজ হজ আদায় করতে অক্ষম হয় তাহলে তার পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তির হজ পালনকে বদলি হজ বলে। কয়েকটি হাদিস থেকে বদলি হজের বিধান পাওয়া যায়। নীচে হাদিসগুলো উল্লেখ করা হল। ১. খাছআম গোত্রের জনৈকা মহিলা রাসূলুল্লাহ [সা.] কে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ [সা.] আল্লাহ তার বান্দাদের ওপর যে ফরজ আরোপ করেছেন তা আমার পিতাকে খুব বৃদ্ধ অবস্থায় পেয়েছে। তিনি বাহনের ওপর স্থির হয়ে বসতে পারেন না। তবে কি আমি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করে দেব? তিনি বললেন, হাঁ। ঘটনাটি ছিল বিদায় হজের সময়কার। ২. আবু রাযিন আল আকিলি থেকে বর্ণিত। তিনি এসে, রাসূলুল্লাহ [সা.] কে জিজ্ঞাসা করে বললেন, আমার পিতা খুব বৃদ্ধ, তিনি হজ ও উমরা পালন করতে পারেন না। সওয়ারির ওপর উঠে চলতেও পারেন না। রাসূলুল্লাহ [সা.] বললেন, তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ ও উমরা করো। ৩. রাসূলুল্লাহ [সা.] এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন, শুবরামার পক্ষ থেকে লাব্বাইক। তিনি বললেন, শুবরামা কে? লোকটি বললেন, আমার ভাই বা আত্মীয়। তিনি বললেন, তুমি কি নিজের হজ করেছ? লোকটি বললেন, না। তিনি বললেন, আগে নিজের হজ করো। তারপর শুবরামার হজ। তিন প্রকার হজের মধ্যে বদলি হজ কোন প্রকার হবে তা, যে ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ করা হচ্ছে তিনি নির্ধারণ করে দেবেন। যদি ইফরাদ করতে বলেন তাহলে ইফরাদ করতে হবে, যদি কেরান করতে বলেন তাহলে কেরান করতে হবে, আর যদি তামাত্তু করতে বলেন তাহলে তামাত্তু করতে হবে। এর অন্যথা হলে হবে না। বদলি-হজ, ইফরাদ হজ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বরং ওপরে উল্লেখিত দ্বিতীয় হাদিসে হজ ও উমরা উভয়টার কথাই আছে। এতে, বদলি হজকারী তামাত্তু হজ করতে পারবে, এর দিকে ইশারা রয়েছে। বদলি হজকারী ইফরাদ ভিন্ন অন্য কোনো হজ করলে তার হজ হবে না, হাদিসে এমন কোনো বাধ্য-বাধকতা খোঁজে পাওয়া যায় না। ‘হজ’ শব্দ উচ্চারণ করলে শুধুই ইফরাদ বোঝাবে, এর পেছনেও কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। কেননা হজের সাথে উমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গিয়েছে বলে এক হাদিসে এসেছে। (হজে উমরা প্রবিষ্ট হয়েছে) তাই রাসূলুল্লাহ [সা.] খাছয়াম গোত্রের মহিলাকে তাঁর পিতার বদলি-হজ করার অনুমতি দেয়ার সময় যে বলেছেন, তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ করো’, এর দ্বারা তিনি উমরাবিহীন হজ বুঝিয়েছেন, এ কথার পেছনে আদৌ কোনো যুক্তি নেই। বদলি-হজ কেবলই ইফরাদ হজ হতে হবে, ফেকাহশাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য কোনো কিতাবেও এ কথা লেখা নেই। ফেকাহশাস্ত্রের কিতাবে যা লেখা আছে, তা হল, বদলি-হজ যার পক্ষ থেকে করা হচ্ছে তিনি যে ধরনের নির্দেশ দেবেন সে ধরনের হজই করতে হবে। এখানে আমি প্রসিদ্ধ কিতাব বাদায়েউস্সানায়ের এবারত তুলে দিচ্ছি— অর্থাৎ, (যিনি বদলি-হজ করাচ্ছেন) তিনি যদি শুধু হজ করার নির্দেশ দেন অথবা শুধু ওমরা করার নির্দেশ দেন, আর বদলি-হজকারী কেরান হজ করল তবে বদলি-হজকারীকে—ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর কথা অনুসারে—ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র.) এর নিকট, নির্দেশকারীর পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। এটাকে বরং এস্তেহসান মনে করি ও এ ব্যাপারে কিয়াস ছেড়ে দিই। যিনি বদলি হজ করাচ্ছে, তিনি যদি হজ করার নির্দেশ দেয় আর বদলি-হজকারী উমরা করে, তবে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কেননা সে নির্দেশ মোতাবেক কাজ করেনি। আর যদি সে উমরা করে, ও পরবর্তীতে মক্কা থেকে হজ করে তা হলে সকলের মতে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কেননা বদলি-হজকারীর প্রতি, যিনি হজ করালেন, তার নির্দেশ ছিল সফরটা হজের জন্য করার, পক্ষান্তরে সে সফর ব্যতীতই করেছে। কারণ প্রথম সফরটা সে উমরার জন্য ব্যবহার করেছে। তাই নির্দেশের উল্টো কাজ করেছে, সে জন্যই তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদি নির্দেশদাতা হজ ও উমরা উভয়টা এক এহরামে একত্রিত করে আদায় করতে বলেন, আর বদলি-হজকারী নির্দেশদাতার জন্য শুধু হজ করল, কিন্তু উমরা করল নিজের জন্য, তবে সে—ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর এক আপাত বর্ণনা অনুসারে—নির্দেশের উল্টো করল। ওপরের উদ্ধৃতি এটা স্পষ্ট যে বদলি-হজ যিনি করাচ্ছেন তাঁর কথা মতো হজ সম্পাদন করতে হবে। তিনি যে ধরনের নির্দেশ দেবেন সে ধরনের হজ করতে হবে। নির্দেশ মোতাবেক হজ না করলে কোথায় কোথায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। বদলি-হজকারীকে, সর্বাবস্থায় ইফরাদ হজ করতে হবে, এ কথা ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ কেউই বলেননি। গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান