
ছবি সংগৃহীত
স্বাগত ১৪২০: শুভ বাংলা নববর্ষ
আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৩, ১৮:০০
ছয় ঋতুর বিচিত্র রূপে রূপবতী আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এ বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর চাকা ঘুরতে ঘুরতে আবার এসেছে বৈশাখ! আজ বাংলার ঐতিহ্যবাহী নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশি তথা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে বাংলা নববর্ষ আনন্দ-উল্লাসে উদযাপিত হয়। পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ্য হিসেবে বরণ করে নেয়।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোন পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। বাংলা দিনপঞ্জীর সঙ্গে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুর হয় মধ্যরাতে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুর হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব।
ইতিহাস-
হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত।এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত। ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতেহত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।
তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।
নববর্ষ উদযাপন-
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেক কৃষককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন করাতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। প্রথমিক পর্যায়ে নববর্ষের মূল তাৎপর্য ছিল একটি হালখাতা তৈরি। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। এর জন্য লেনদেনে বকেয়ার বিষয়টি নতুন করে সবার নজরে আনা হত। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সব স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হত।
আধুনিককালে বর্ষবরণ-
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। তখন ব্রিটিশ আমল। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার আয়োজন করা হয়। এরপর আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে।
রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ
স্বাধীনতা-পূর্বে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রতিবাদে ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫ সালে) রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদাযাপনের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানায় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। ১৯৭২ সালের পর থেকেই মূলত এটি জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৮০ সালে এই উৎসবকে আরো এক ধাপ বাড়তি রঙ্গের ছোঁয়া দিতে প্রচলন হয়েছে বৈশাখী শোভাযাত্রার।
মঙ্গল শোভাযাত্রা-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে প্রতি বছর যে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয় সেটিই হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর সূচনা ১৯৮৯ সালে। তারও আগে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয় যশোরে, ১৯৮৭ সালে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ঢাকাবাসীর কাছে নববর্ষ উৎসবের একটি প্রধান আকর্ষণ। শোভাযাত্রা ছাড়াও রাজধানীর ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, শহীদ মিনার, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, লেডিস ক্লাব, অফিসার্স ক্লাব ও পুরান ঢাকাসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে নববর্ষের নানা ব্যঞ্জনা ও উৎসব।
বঙ্গাব্দে ১২ মাস-
সনপদ্ধতি চালু করার আগে বঙ্গে শক বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হতো। শক রাজবংশকে স্মরণীয় করে রাখতেই ৭৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রবর্তিত শকাব্দ (শক বর্ষপঞ্জির) থেকে বাংলা সনের নামগুলি এসেছে। বিভিন্ন তারকারাজির নামে বাংলা মাসগুলির নামকরণ করা হয়। যেমন, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রাইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্পুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। অগ্রহায়ন মাসের নামের আরেকটি ব্যাখ্যা হলো: অগ্র অর্থ প্রথম, হায়ন অর্থ বর্ষ বা ধান। আগে এই মাস থেকেই বছর গণনা শুরু হতো; কিম্বা এই সময়ে প্রধান ফসল ধান কাটা হতো। তাই এই মাসের নাম হয় অগ্রহায়ণ।
বউমেলা-
ঈশা খাঁর সোনারগাঁয় ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম 'বউমেলা'। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো হিসেবে এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। পাঁঠাবলির রেওয়াজও পুরনো। বদলে যাচ��ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে। বউমেলায় কাঙ্ক্ষিত মানুষের খোঁজে কাঙ্ক্ষিত মানসীর প্রার্থনা কিংবা গান্ধর্ব প্রণয়ও যে ঘটে না সবার অলক্ষে, তা কে বলতে পারবে।
ঘোড়ামেলা-
এ ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ঘোড়ামেলা। লোকমুখে প্রচলিত জামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। এক দিনের এ মেলাটি জমে ওঠে দুপুরের পর থেকে। হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারণে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তথাপি সব ধর্মের লোকজনেরই প্রাধান্য থাকে এ মেলায়। এ মেলায় শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নানারকম আনন্দ-উৎসব করে পশ্চিমের আকাশ যখন রক্তিম আলোয় সজ্জিত উৎসবে, যখন লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত, তখনই এ মেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। এ কীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা।
চট্টগ্রামে বর্ষবরণ-
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূল কেন্দ্র ডিসি পাহাড় পার্ক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এখানে পুরোনে বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার জন্য দুইদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থবকে নানা প্রামীণ পন্যের পশরা। থাকে পান্তা ইলিশের ব্যবস্থাও।
চট্টগ্রামে সম্মিলিত ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্যোগ ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিকগণের চেষ্টায়। ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৯৭৮ সালে এই উৎসা এখনকবর ডিসি হিল পার্কে সরিয়ে নেওযা হয়। ১৯৭৮ সালের উদ্যোগের সয্গে জড়িত ছিলেন ওয়াহিদুল হক, নির্মল মিত্র, মিহির নন্দী, অরুন দাশ গুপ্ত, আবুল মোমেন সুভাষ দে প্রমূখ। প্রথম দিকে প্রত্যেক সংগঠন থেকে দুইজন করে নিয়ে একটি স্কোয়াড গঠন করা হত। সেই স্কোয়াডই সম্মিলিত সঙ্গীত পরিবেশন করতো। ১৯৮০ সাল থেকে সংগঠনগুলো আলাদাভাবে গাণ পরিবেশন শুরু করে। পরে গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ যুক্ত হওয়ার পর অনুষ্ঠানে নাটকও যুক্ত হয়েছ। নগরীর অন্যান্য নিয়মিত আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শিশু সংগঠন ফুলকীর তিনদিন ব্যাপী উৎসা যা শেষ হয় বৈশাখের প্রথম দিবসে। নগরীর মহিলা সমিতি স্কুলে একটি বর্ষবরণ মেলা হয়ে থাকে।
পার্বত্য জেলায়, আদিবাসীদের বর্ষবরণ-
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রজাতিস্বত্তা রয়েছে যাদের প্রত্যেকেরই বছরের নতুন দিনে উৎসব আছে। ত্রিপুরাদের বৈশুখ, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব। বর্তমানে তিনটি জাতিস্বত্ত্বা একত্রে এই উৎসবটি পালন করে। যৌথ এই উৎসবের নাম বৈসাবি। উৎসবের নানা দিক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো মার্মাদের পানি উৎসব।
পশ্চিমবঙ্গে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন-
পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। বাংলার গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়ে সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুবসংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এইদিনেই সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। এছাড়া বহু পরিবারে বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ প্রতিটি পরিবারে স্নান সেরে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি বহুলপ্রচলিত। বাড়িতে বাড়িতে এবং সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এদিন থেকে তাদের ব্যবসায়িক হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করে, যার পোশাকি নাম হালখাতা। গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে পয়লা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়।
কলকাতা-
ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম 'চৈত্র সেল'... তাই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কলকাতার সমস্ত মানুষ একমাস ধরে নতুন জামাকাপড়, ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে। পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এইদিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত।
বঙ্গাব্দের উৎসের সন্ধানে-
বঙ্গাব্দের সাথে সম্রাট আকবর প্রবর্তিত ‘তারিখ ই এলাহী’ সনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সুতারাং তারিখ ই ইলাহী নিয়ে কিছু আলোচনা অপ্রাসাঙ্গিক হবে না। আকবরনামা থেকে জানা যায় সম্রাট আকবর নতুন একটি ধর্মমত দ্বীন ই ইলাহীর মত একটি নতুন অব্দ ও তার রাজত্ব কালে ২৯ তম বছরে প্রবর্তন করেন। এই নতুন সনটির গননা পদ্ধতি হিজরী অনুসৃত চান্দ্র পদ্ধতির পরিবর্তে হবে সৌর ভিত্তিক। এই নতুন অব্দের নাম হয়েছিল ‘তারিক-ই-ইলাহী’... নিঃসন্দেহে সম্রাট আকবর ১০৭৯ সালে পারস্য সম্রাট সুলতান সম্রাট জালাল উদ্দিন কর্তৃক প্রবর্তিত সৌর গননা ভিত্তিক ইরানী সন দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়েছিল। এখনে উল্লেখ্য করা যেতে পারে ৬৪৮ খ্রীষ্টাব্দে পারস্যে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডিন হলে, পুরানো ইরানীয়ান ক্যালেন্ডারে পরিবর্তে স্থানীয়রা সাদরে ইসলামী চান্দ্র ক্যালেন্ডার গ্রহন করে। ১০৭৪-৭৫ সালে পারস্য সম্রাট সেলজুক সুলতান জালাল উদ্দীন মালেক শাহ সুবিখ্যাত জোর্তিবিদ ও পন্ডিত কবি ওমর খৈয়াম ও অন্যান্য ৭ জন পন্ডিত ব্যাক্তিকে পুরানো ইরানী ক্যালেন্ডার পূর্নসংস্কারের নির্দেশ দেন। এই পন্ডিতবর্গ কর্তৃক পরিমার্জিত বর্ষপঞ্জী প্রকাশ হয় ৮৭১ হিজরীর রমজান মাসের ১০ তারিখ। অর্থ্যাৎ ১০৭৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই মার্চ থেকে তারিখটি ‘তারিখ ই জালালী’ নামে পরিচিত লাভ করে। জালালী সংস্কার নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে আমরা সেখানে না যেয়ে এ কথা বলতে পারি যে, এই ক্যালেন্ডারে ৩৩ বছরে ৮টি অর্ধদিবস অন্তর্ভূক্ত করা হয়। আধুনিক পারস্য সম্রাট রেজা শাহ পাহলভী পুনরায় এই বর্ষপঞ্জী আধুনাকয়ন করেন (১৯২০)। তিনি পুনরায় পুরানো নামগুলো চালু করেন
আরবী মাসের পরিবর্তে। প্রথম ৬টি মাস হবে ৩১দিনে, পরের পাঁচটি মাস ৩০ দিনে এবং শেষ এসফান্দ মাসটি হবে ২৯ দিনে অথবা ৩০ দিনে, যদি বছরটি অধিবর্ষ হয়।
আকবর ইরানীয় সংস্কারে উজ্জীবিত হয়ে তারিখ ই জালালীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তারিক ই ইলাহী প্রবর্তন করে। এখনে উল্লেখ্য যোগ্য যে মোঘলরা ধর্ম বিশ্বাসে সুন্নী মুসলমান, সংস্কৃতিতে ইন্দো পারসিক, আর জাতিতে তুর্কী মোঙ্গল। দূরদর্শী আকবর বুজেছিলেন যে সূর্য-চন্দ্র খচিত প্রাচীন ভারতীয় বর্ষপঞ্জী অথবা বিশুদ্ধ চান্দ্র গননা ভিত্তিক হিজরী আব্দ বৈচিত্র্যময় ষড়ঋতুর দেশ ভারতবর্ষে অচল। এর পরিমার্জন আবশ্যক। তাই হিজরী সনের সীমাবদ্ধতাকে ও ভারতীয় মিশ্রসন সমূহের জটিলতাকে মাথায় রেখে তিনি জোর্তিবিদদের নির্দেশ দিলেন জেলালী অব্দের আদর্শে একটি সৌর গননাভিত্তিক জাতীয় ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জী প্রনয়ন করার। তারই ফলশ্রুতিতে তারিখ ই ইলাহী। কিন্তু তার মৃত্যুর পর এই জাতীয় ক্যালেন্ডারের প্রচলন বন্ধ হয়ে যায়। হিজরী সন পুনরায় সরকারী কাজে ব্যাবহৃত হতে থাকে এবং তারিক ই ইলাহী আদর্শে প্রনীত স্থানীয় সন সমূহ বিশুদ্ধ সৌর চরিত্র হারিয়ে ফেলে, পুনরায় সৌর-চন্দ্র মিশ্র জটিলতায় প্রত্যাগমন করে আকবরের সংস্কারের মূল আত্মাকে ধ্বংস করে। আকবরের দূরদর্শিতা সাধারন পঞ্জিকাকারদের মধ্যে আশাও করা যায়না। আকবর ছিলেন তারকালের অনেক অগ্রগামী পুরুষ। এই জন্যই তিনি ইতিহাসে ‘আকবর দি গ্রেট’... অন্য একটি মত হলো সম্রাট আকবর ৯৬৯ হিজরীতে এক ঘোষনায় উল্লেখ্য করেছিলেন যে, অতঃপর সাম্রাজ্যের সমস্ত প্রসাশনিক কাজে যে সন ব্যাবহৃত হবে তা ৯৬৯ হলেও এর পদ্ধতি হবে কিন্তু সৌর ভিত্তিক, অর্থ্যাৎ প্রস্তাবিত অব্দটি হবে সৌরঅব্দ।– যা ঋতুর সাথ্র সঙ্গতি রেখে আবর্তিত হবে। এই নতুন অব্দের নামকরন হয় তারিখ ই ইলাহী। সনটি অবশ্য তার জোর্তিবিদদের সাথে পরামর্শ করে আকবরের সিংহাসনে আরোহন বর্ষ অ র্থ্যাৎ ৯৬৩ হিজরী থেকে কার্যকর করা হয়।
আইন ই আকবরী গ্রন্থে তারিখ ই ইলাহীর জন্ম সন্মন্ধ্যে বিশদ বর্ননা দেয়া আছে। এ সম্পর্কে একস্থানে বলা আছেঃ
আকবর বেশ কিছু দিন ধরে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন স্থানের দিন গননা সমস্যাকে সহজ করে তোলার জন্য একটি নতুন মাস ও বছর গননা পদ্ধতি প্রবর্তন করার ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছিলেন। তিনি হিজরী প্রথা ব্যাবহারের বিরোধী ছিলেন।…. আমীর ফতে উল্লাহ শিরাজীর প্রচেষ্টায় এই নতুন অব্দের প্রচলন হলো। এই অব্দের দিন ও মাস গুলো অধিবর্ষহীন। মাসের দিনের সংখ্যা ২৯ ও ৩২... ইলাহী অব্দের মাস গুলো ফরওয়ারর্দিন, আর্দিবিহিষ্ট, তির, আমুরদাদ, শারেবার, মিহর, আবান, আজব, দয়, রহমন, ইসফন দারমুজ। আকবর নামাতে ১ থেকে ২৭ তম ইলাহীর বর্ষারম্ভের দিন গুলো রেকর্ড করা আছে। এতে দেখা যায় প্রতিটি বর্ষ শুরু হয়েছিল ১০ থেকে ১২ই মার্চ এর মধ্যে। তখনকার বিশ্বাস মতে মহাবিষুব সংক্রান্তির ক্ষন থেকে। সম্রাট আকবর প্রকৃতই বর্তমানে প্রচলিত বঙ্গাব্দ সরাসরি প্রবর্তন না করলেও তারিক ই ইলাহীর আদর্শে স্থানীয় ভাবে পন্ডিতবৃন্দ বাংলা সন প্রচলন করেছিলেন। একই ভাবে পূর্ব ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যে তারিক ই ইলাহীর আদর্শে স্থানীয় সন প্রচলিত হয়েছিল, যেমন বাংলা ও উড়িষ্যার আমলি ও বিলায়েতি সন বাংলা, বিহার, দক্ষিন্যাত্য ও তৎকালীন বোম্বের বিভিন্ন ফসলি সন। যদিও বাংলা সন মেষ রাশিতে সূর্যের প্রবেশের সাথে সাথে বর্ষারম্ভ গননা করা হত, তবে অন্য ফসলি সন সমূহ স্থানীয় কোন ঐতিহাসিক ঘটনাকে বর্ষারম্ভ গন্য করত। যেমন উড়িষ্যার প্রচলিত আমলি সনের আরম্ভ ধরা হয় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের জন্ম দিন থেকে। মনে করা হয় তিনি পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের স্থানটি চিহ্নিত করেছিলেন ১১১৯ সালে।
তবে পোপ গ্রেগরী, পারস্যের সম্রাট জালাল উদ্দিন মালিক শাহের মত বর্ষপঞ্জী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেছিলেন সম্রাট আকবর। আর এখানেই আকবরের মহত্ব নিহিত।। একারনেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহা শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্বরন করেনঃ The mughal emperors appaear to have strongly felt the necessity of a reformed solar calendar and a central observatory, The great Akbar introduce The Jelali calendar of Iran which is one of the best solar calendar (Collected works of Meghnad Saha Vol.3 page 59, Ed. Santimoney Chatterjee, Saha institute of nuclear Physics, Orient Longman, 1992)
বঙ্গাব্দ হিসাবের সহজ পদ্ধতি
মনে করা হয় বাংলা সন চালু হয় ৯৬৩ হিজ রীতে অর্থ্যাৎ ১৫৫৬ সনে। তাই ৯৬৩ সনকে বাংলা সন ধরা হয়, তবে এটিকে সৌর বছর হিসাবে গননা করা হয়। সুতারাং কোন খ্রীষ্টীয় অব্দ থেকে বাংলা সন পেতে হলে আমরা নিম্নলিখিত সূত্র ব্যাবহার করতে পারিঃ
ধরা যাক X নির্নেয় বাংলা সন;
Y প্রদত্ত খ্রীষ্টীয় সন
তাহলে আমরা লিখতে পারি
X=৯৬৩+ (Y- ১৫৫৬)
ধরা যাক Y= ২০০০ সন।
X= ৯৬৩+(২০০০-১৫৫৬)
= ৯৬৩+৪৪৪
= ১৪০৭ বাংলা সন।
বাংলা পঞ্জিকা
বাংলা পঞ্জিকা পূর্বে জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এখন পঞ্জিকায় বর্ষফল, মাসফল, রাশিফল প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। বাংলায় পঞ্জিকা প্রকাশের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয় রঘুনন্দন প্রথম পঞ্জিকা গণনা করেন। এর পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে পঞ্জিকা গণনা আরো প্রসারিত হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা প্রথম মুদ্রিত হয়। এরপর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্জিকা সংস্কার করে মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা। ১৯৫৭ সালে ভারত সরকারের অধীনে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে পঞ্জিকার সংস্কার হয় এবং এই সংস্কারপ্রাপ্ত পঞ্জিকা বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই ভারতের রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হয়।
নবপ্রণীত পঞ্জিকা
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সকল পঞ্জিকাই প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হতো। কিন্তু সূর্যসিদ্ধান্তের কিছু ত্রুটির কারণে সেই গ্রন্থ অনুসারে নির্ণীত তিথি, নক্ষত্র, ইত্যাদির সময়ের সাথে মহাকাশে ঘটিত প্রকৃত তিথি নক্ষত্রের সময়ের কিছু পার্থক্যের সৃষ্টি হচ্ছিল। তখন গণিতজ্ঞ মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সূর্যসিদ্ধান্তের সংস্কার ঘটিয়ে একটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত পঞ্জিকা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা। ১৯৫২ সালে ভারত সরকারের উদ্যোগে গঠিত পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি (Calendar Reform Committee) ভারতীয় পঞ্জিকাগুলিতে সংস্কারসাধন করে যে নতুন রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ প্রণয়ন করে সেই পঞ্জিকার বিজ্ঞানভিত্তিক গণনার সাথে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার গণনা সম্পূর্ণ এক। উভয় পঞ্জিকাতেই নির্ভুল ভাবে তিথি, নক্ষত্র, ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই পঞ্জিকাকে স্বীকৃতি প্রদান করে এটি গ্রহণ করেছে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সকল শাখা, অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রম, তারকেশ্বর মন্দির, কাঞ্চী মঠ, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সমস্ত অনুষ্ঠান বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে পালিত হয়।
সহযোগী বর্ষপঞ্জি
বঙ্গাব্দ গণিত হয় হিন্দু সৌর পঞ্জিকানুসারে, যেটি আবার সূর্য সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। হিন্দু সৌর পঞ্জি শুরু হয় মধ্য এপ্রিলে। বাংলাদেশের (বাংলাদেশে সংশোধিত বঙ্গাব্দানুসারে নববর্ষ পালিত হয) বাইরে পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, কেরল,মণিপুর, নেপাল, ওড়িশা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরায় এই বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনকেই নতুন বর্ষের শুরু হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। নববর্ষ আবার মেষ সংক্রান্তি হিসেবেও পরিচিত।
ভাস্করাব্দ
ভাস্করাব্দ পূর্ব ভারতের অসমে প্রচলিত সৌর অব্দবিশেষ। এটির সঙ্গে বঙ্গাব্দের বিশেষ সাদৃশ্য আছে। সৌর ভাস্করাব্দের বারটি মাস এবং তাদের দৈর্ঘ্য নিচে দেখুন:
ক্রম নাম অসমীয়া দিনসংখ্যা
১ বৈশাখ বহাগ ৩০/ ৩১
২ জ্যৈষ্ঠ জেঠ ৩১ / ৩২
৩ আষাঢ় আহাৰ ৩১ / ৩২
৪ শ্রাবণ শাওন ৩১ / ৩২
৫ ভাদ্র ভাদ ৩১ / ৩২
৬ আশ্বিন আহিন ৩০ / ৩১
৭ কার্তিক কাতি ২৯ / ৩০
৮ অগ্রহায়ণ অঘোণ ২৯ / ৩০
৯ পৌষ পুহ ২৯ / ৩০
১০ মাঘ মাঘ ২৯ / ৩০
১১ ফাল্গুন ফাগুন ২৯ / ৩০
১২ চৈত্র চ’ত ৩০ / ৩১
এই অব্দে নববর্ষারম্ভ হয় সৌর বৈশাখ মাসের প্রথম দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ। মহাসমারোহে এই দিন সমগ্র অসমে পালিত হয় বিহু উৎসব।
সূত্র
দৈনিক প্রথম আলো
দৈনিক যুগান্তর
উইকিপিডিয়া
মাসিক কিশোর কন্ঠ
সামহোয়্যারইন ব্লগ
বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ
বাংলাপিডিয়া
- ট্যাগ:
- বাংলাদেশ
- লাইফ
- জীবন চর্চা