ছবি সংগৃহীত

সেনসেশন আউট, গ্রিন লাভ ইন : মেহেদী উল্লাহ

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০১৬, ১৪:৪৯
আপডেট: ১২ আগস্ট ২০১৬, ১৪:৪৯

গ্রাফিক্স : আকরাম হোসেন।

(প্রিয়.কম) আজ প্রিয় পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো মেহেদী উল্লাহ’র গল্প ‘সেনসেশন আউট, গ্রিন লাভ ইন’।

কোহিনুর খালাকে ‘খালাম্মা’ ডাকার আগে তিনি আমাদের বাড়ির ‘কাজের’ মেয়ে ছিলেন। তিনি আমার চেয়ে দশ-বারো বছরের বড় হতে পারেন। কোহিনুর খালা সম্পর্কে বলতে গিয়ে একদিন আম্মা বলেছিলেন,‘তোর নানীর বুদ্ধি ধরলে আমার সংসারটা আজ স্বাধীন থাকত না।’ নানীই কোহিনুর খালাকে যোগাড় করে দিয়েছে। আমরা তখন থাকতাম নোয়াখালীর খাসেরহাটে। আমার আব্বা খাসেরহাট কলেজে বাংলা পড়াতেন। আর আমার নানাবাড়ি ছিল তারচেয়েও প্রায় আট-দশমাইল দক্ষিণে, চরবাটায়। কোহিনুর খালার বাবা নোয়াখালীর উপকূলীয় বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে আঁটি বেঁধে বাড়ি বাড়ি বেচতেন। সেটা উন্নিশশো চুরানব্বই সালের কথা। এক আঁটি লাকড়ির দাম চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা ছিল। আঁটিতে এক মণের বেশি শুকনো গাছের ডাল থাকতো, চিকন-চিকন, লম্বা-লম্বা। বেশি থাকতো কেওড়ার ডাল। স্থানীয়রা শুকনো ডালকে ‘ঠেঙ্গা’ বলতো। তো, সেই ঠেঙ্গা বেচেও কোহিনুর খালার আব্বা ভীষণ বেকায়দায়, সংসারে টানাটানি। কোহিনুর খালারা ছিলেন পাঁচবোন, ছয় ভাই। ছেলে-মেয়েগুলো ছয়-সাত পেরোলেই যে কারো বাড়িতে কাজের সূত্রে চলে যাবে, এটা তাদের পারিবারিক ট্রেডিশন। তা নিয়ে কোহিনুর খালার আম্মা-আব্বার কোনো চিন্তা নাই। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো কোহিনুর খালার বেলায়। সে পরিবারের একেবারে ছোট সন্তান বলে অভাবের সংসারেও বাপ-মা তাকে হাতছাড়া করতে চায় না। নানী বোঝালেন তাদের। বললেন, ‘এ আর এমন কিয়া! দি দ’। আমার মাইয়্যার সংসারে তঁর মাইয়্যা আদরে মানুষ অইবো। হেতির সংসারে তো কোনো ছিজ্জত নাই।’
অবশেষে আমাদের দিক থেকে না কি কোনো সমস্যাই হয় নি,‘ছিজ্জত’ তৈরি করলেন কোহিনুর খালা নিজেই।
আম্মাকে এ প্রসঙ্গে কিছু জানতে চাইলে তিনি বলতেন,‘ওদ মারি খোদ লইতে চাও কেন্। কোতুহল থাইকলে একদিন পুরাটাই শুইনো, লাগলে কোহিনুররে খবর দিবো, ওতো আইতেই চায় এখানে বেড়াতে। খোচানি স্বভাব বাদ দাও।’
আমি ‘জি আম্মা’ বলে উঠতে বাধ্য হতাম। কিন্তু মন থেকে কোহিনুর খালার হিস্টোরি শোনার বাসনা উধাও হয় নাই।
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমার আম্মা অন্য অনেক মহিলার চেয়ে বেশি বুঝতেন। তার মধ্যে কি যেন একটা আছে! যার গুণে তিনি খুব সহজেই সব কিছু সামলে নিতে পারতেন। এই যেমন ধরুন, আমাদের বাড়ির আশপাশে যখন সবার ঘরভর্তি সন্তান, কম করে হলেও চার-পাঁচটা সন্তান তখন আম্মা মাত্র একটা অর্থাৎ শুধু আমাকেই জন্মদানের পর সন্তান কামনার হাল ছেড়েছিলেন। আশপাশের সবাইকে ছোটকাল থেকেই বলতে শুনতাম, ‘তুমার আম্মা লাখে একটা’।
নানী সবসময় আমাদের ফ্যামিলি নিয়ে নাক গলিয়ে আম্মার কাছে নিজেকে বুদ্ধিজীবী প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। অথচ আম্মা তার কথা শোনতেন ঠিকই, পরে এই কান দিয়ে ঢুকিয়ে ওকান দিয়ে বের করে দিতেন। জগতে আম্মার শত্রু ওই একজনই। এছাড়া আজ অবধি আম্মার কোনো শত্রু জন্মায় নাই। চিন্তা করলে টাসকি খাই! অথচ কোহিনুর খালা, তার মেয়ে, এমনকি আমার আব্বাও আম্মার জম্মের শত্রু হতে পারতেন। আম্মা তা হতে দেননি। তিনি নানীর কথা না শুনে তার ভাষায় ‘সংসারটাকে স্বাধীন করেছেন’।

আমরা এখন ঢাকায় থাকি। আমি বড় হয়ে গেছি বলতে গেলে। আইসিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে সদ্য মাস্টার্স করে একটা মোবাইল ফোন কোম্পানীতে ঢুকেছি আইটি অফিসার হিসেবে। মাইনে ভালো। আগে হলে আমার এ বেতনের পয়সায় আমাদের মতো দশটা ফ্যামেলি চালানো যেত। মাঝখানে আমরা নোয়াখালী ছেড়ে চাঁদপুর চলে গেছি। সেটা আটানব্বই-নিরানব্বই সালের দিকে। আমার আব্বা ওখানকার একটা কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন। একরকম বাধ্য হয়েই। তাই নোয়াখালীতে আমাদের আর থাকা হলো না। এখন আমরা ঢাকায়। আমরা বলতে আমি আর আম্মা। আমার আব্বা আমাদের সঙ্গে নাই। তিনি চাঁদপুরেই আছেন। আর কোথাও আমাদের নিজের বাড়ি ছিল না। নোয়াখালী থেকে ঢাকা- সবখানে আমরা ভাড়া বাড়িতে ছিলাম। আমাদের নিজের কোনো বাড়ি ছিল না। এখন অবশ্য আছে, চাঁদপুরে দাদার ভিটায় একটা আধা টিন, আধা পাকা বাড়ি। তাও তোলা হয়েছে বেশি দিন হয়নি।
বছর পাঁচেক আগে আম্মা খবর দিয়েছিলেন কোহিনুর খালাকে। আমাদের চাঁদপুরের ভাড়া বাসায় তার বেড়ানোর দাওয়াত। তিনি কবুল করে সঙ্গে সঙ্গে এসে উপস্থিত। উপস্থিতি খানিক জুরানোর পর আম্মা বললেন, ‘কোহিনুর আমার পোলায় তুমার হিস্টোরি শুনতে চায়। ওরে বলা যাবে। আমিই বলতে পারতাম, কিন্তু ভাবলাম তুমি ছাড়া কি কইতে কি কই, তুমার নিজের ঘটনা তুমি নিজের মুখে শোনাও। তবে, ওর আব্বাও বলতে পারতো। তা তো তুমি জানো, উনি ঠাণ্ডা মানুষ। কথাবার্তা কম বলেন। তাছাড়া আমার সাথে যেখানে মাইপা বলেন, সেখানে বাইচ্চা-কাইচ্চার সাথে উনার কি কথা থাকতে পারে?’

কোহিনুর খালা প্রতিউত্তর করলেন না। উনি মাথা নেড়ে আম্মার কথার বশ্যতা স্বীকার করলেন। আম্মাকে সম্ভবত জমের মতো ভয় পান। অথবা হতে পারে শ্রদ্ধা করেন। আম্মাই পরবর্তীকালে আমাকে আদেশ করেছিলেন, ‘কোহিনুরকে আর নাম ধরে ডাকবে না, খালাম্মা ডাকবে।’ তিনি যখন আমাদের বাড়ি কাজ করতে এসেছিলেন, নতুন নতুন আমি তাকে কোহিনুর বলেই ডাকতাম। ডাকতে ডাকতে অভ্যাসও করে ফেলেছিলাম। হঠাৎ কি থেকে কি ঘটল, কোহিনুর খালাও আমাদের বাড়ি ছাড়লেন, আর তার পরেই আদেশটা এলো। তখন বয়েস কম থাকায় অতটা বুঝিনি। আম্মা বললেন, তাই মেনেছিলাম। মাঝে মাঝে উৎসব-টুৎসবের রাতে আম্মা হঠাৎ ডেকে বলতেন, ‘কোহিনুর খালাকে একট ফোন দে।’ আম্মা কম কথার মানুষ। এই আদেশের অর্থ হলো, কোহিনুর খালার শরীর কেমন, তার মেয়েটা কেমন আছে, তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা এন্তার খোঁজ-খবর নেওয়া। আমি ভাবতাম, সে যে কোহিনুর খালা আমাদের বাড়ি ছাড়লেন, আর তার কদরও বেড়ে গেল। আমাদের বাড়ি ছেড়ে তার চলে যাওয়া, আর আম্মার কাছে তার কদরের হার সমানুপাতিক।

কোহিনুর খালা আর আম্মা ব্যাপক হেসেছিলেন। অবশেষে তার হিস্টোরি নিয়ে বসলেন খালা। খাস নোয়াখাইল্যা ভাষায় কাহিনি শুরু করলেন কোহিনুর খালা। আম্মারটায় অবশ্য পরে চাঁদপুর ঢুকছে। যেমন, নোয়াখালীর মানুষ ‘তাদের’ শব্দটাকে বলে ‘হেতারা’, আর চাঁদপুরের লোক বলে ‘হেরা’। উভয়ের মিশ্রণে আম্মারটা হয়ে গেছে ‘হ্যারা’। এই রকম আর কি। তাই তাদের ভাষায় কথা বললে অনেকের ধরতে সমস্যা হবে। বৃত্তান্ত আমিই ভেঙে বলি।

আমার হাত-পা কাঁপছে। প্রথম প্রথম তো। এর আগে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি কখনো। যেতে হবে আমাদের বাসার গলিটার মুখে। সেখানে একটা ওষুধের দোকান আছে। গিয়ে কিভাবে চাইবো, মনে মনে তাও ভাবছি। একবার মুখ ফসকে বের করে দিলেই হবে। আর দেখে নিবো আশপাশে যাতে কেউ না থাকে।

কোহিনুর খালার ব্যাপারে আমার নানীর বুদ্ধি ছিল, মাগীরে বার করি দে। খানকি-মাগী। আঁর মাইয়্যার সংসারে সাপ অই ঢুকছে। বার করি দে লাতি দি।
আম্মা দুর থেকে সব দেখতে পান। তাই লাথি দিলেন না কোহিনুর খালাকে। কোথায় যাবে এ অবস্থায়? কোহিনুর খালার বাপের যদি জমিদারী থাকতো তো ভিন্ন কথা। সে তো করে লাকড়ির কারবার। সমাজও একটা বড় ফ্যাক্ট। একটা কিছু পেলেই এদের হয়। তিলকে তাল করে। আর কোহিনুর খালার ব্যাপারটা তো বলতে গেলে একটা বড় ‘তাল’। এইটাকে কি বানায় কে জানে? তাই আম্মা তার জিম্মা ছাড়লেন না। উল্টো নানীকে ছাড়লেন। নানী মেয়ের সঙ্গে বড় ধরনের গোস্বা করেছেন, দুইদিনে ঘটনাটা এলাকা করলেন। ফলে কোহিনুর খালার ঘটনাটা মার্কেট পেল না। নইলে নানী এটাকেই প্রচার করতেন। নানীর মেঝ ছেলের বউ, মানে আমার মেঝ মামি। তিনি একটা মাইক, মানে কোনো ঘটনাকে যদি একঘন্টার মধ্যে কেউ পুরো গ্রাম করতে চায়, কিছুই করতে হবে না, শুধু মামির কানে তুললেই হবে। ব্যাস, তিনিই তখন মাইক অথবা একটা টিভি চ্যানেল।
ঘটনাটা আম্মার নজর কাড়লে কোহিনুর খালাকে নাকি তিনি দু’টো প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এক. পেটের বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলা। দুই. ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে বিয়ে করা।
আম্মা মনে হয় অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। আবার হতে পারে পাননি। উনি যেমন মানুষ তাতে কষ্ট তার ধাতে নেই। আম্মা কাউকে কিছুই না বুঝতে দিয়ে শান্তভাবে কোহিনুর খালার কাছে সেদিন জানতে চেয়েছিলেন, কে ঘটাইছে? কোহিনুর খালা কোন জবাব দিল না। আম্মা কম কথার মানুষ। কোহিনুর খালা উত্তর না দিয়ে আম্মার সময় নষ্ট করছে, এই ভেবে আম্মা তাকে চড় দিতে পারতেন। অথচ আম্মা নাকি কিছুই করেননি। উল্টো কোহিনুর খালাকে সময় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আচ্ছা, বিকেলে বলিস। বিকেল আর গড়ায় নি, এর মধ্যেই দায়ী ব্যক্তি নিজেই ধরা দিল। সে যখন প্রথম এলো, তখন আম্মা ভেবেছিলেন, হয়তো কোহিনুর খালাকে মারধর করতে পারেন এই আশঙ্কায় তাকে জড়িয়ে ধরে ঘরের দিকে টানছেন। দায়ী বলেছিল,‘ চল, ঘরে চল’। নাটকটা ঘরের একটা কক্ষে মঞ্চস্থ হলো। মাত্র এক লাইনের একটা নাটক। সম্ভব! আম্মার চোখে চোখ রেখে ব্যক্তিটি শুধু বলেছিল,‘সব দোষ আমার’। অথচ শুনে অবাক হলাম, এমন একটা কুকীর্তির কথা শুনেও স্ত্রী তার স্বামীর ওপর মোটেও রাগ করেননি। আমার বিশ্বাস, পুরো ভারতবর্ষে আমার আম্মা বলেই শুধু এটা সম্ভব হয়েছিল। আব্বাকে তিনি আর একটা প্রশ্নও করলেন না, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার। উল্টো আব্বাই নাকি স্বীকারোক্তির পর মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। আম্মা কোহিনুর খালাকে ডেকে দুজনে মিলে আব্বাকে চৌকিতে উঠালেন। আব্বার জ্ঞান ফেরার আগে আম্মা কোহিনুর খালার কাছে শুধু জানতে চেয়েছিলেন, ঘটনাটা কবে ঘটেছিল। জোর করেছে, না তুই নিজেই...। কোহিনুর খালা জানালেন, চার মাস আগে আম্মা নাকি পাশের বাড়ি গিয়েছিলেন। তাও মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য। এর মধ্যেই অঘটনটা ঘটেছে। আম্মা বললেন,‘অঘটন বলছিস কেন? তুই তো বললি জোর করেনি। তোদের দুজনেরই মত ছিল। তাহলে!’ এর মধ্যে আব্বার জ্ঞান ফিরে আসলো। তিন সদস্যের বোর্ড মিটিং বসলো। আমি নাকি পাশের ঘরে তখন ঘুমাচ্ছিলাম। জেগে থাকলে কি হতো কে জানে! সেই মিটিংয়েই নাকি আম্মা কোহিনুর খালার উদ্দেশ্যে দুটো প্রস্তাব রেখেছিলেন। খালা দুটো প্রস্তাবই নাকচ করে দিলেন। আব্বা ও আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যা হয়েছে, হয়েছে। আমাকে শুধু গ্রামে আপনাদের খাল পাড়ে যে জমিটা আছে, তার কোনো একটা শনের ঘর তুলে দিন। থাকতে পারবো।’ জবাবে আম্মা বললেন, ‘সে কি কথা! তোকে সতীন মেনে ঘর করতে আমার মোটেও অসুবিধা নাই। তুই এখানেই থাক।’ আম্মা ও আব্বা উভয়ের কাছ থেকেই চোখ সরিয়ে রাখলেন খালা। সেদিন থেকে এই পরিবারে শুরু হয়েছে তার চক্ষুলজ্জা। এই নাকি কোহিনুর খালার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লজ্জা ছিল। তাই তিনি এ সংসারে অন্তত চক্ষুলজ্জা নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকবেন। অবশ্য আব্বা রাজি হয়ে গেলেন। তার কাছে তখন খালা পৃথিবীর বড় আপদ। ভারতবর্ষের মধ্যে বড় গঞ্জণা। তিনি সইতে রাজি নন। আম্মা আর কথা বাড়ালেন না। বৈঠকে তার অনুমোদন কোহিনুর খালা যা চাইতে তাই হবে। তবে একটা ব্যাপারে তিনি উদ্বিগ্ন হলেন। গ্রামের মানুষ ব্যাপারটা কিভাবে নেবেন? তাছাড়া গ্রামতো স্বভাব মতো আগে কোহিনুরের বাচ্চার বাপকে খুঁজবে। না পেলে কোহিনুরের খবর আছে। শিউরে উঠে আম্মার গা। তিনি কোহিনুরকে কথা জানালেন। অথচ এ নিয়ে তার চিন্তা নাই।
এরমধ্যে কোহিনুর খালা নিজেই কথা সাজিয়ে নিলেন। তিনি গ্রামে গিয়ে রটিয়েছেন, এক ফেরিওলার সাথে তার গোপন সম্পর্ক হয়েছে। বাচ্চার বাবা পালিয়ে গেছে। অমানুষ একটা।
গ্রামের মানুষ প্রতারকের ঠিকানা চাইলো। কোহিনুর জানালো, সে জানে না। একদিন গৃহকর্তা ও গৃহকর্তীর অবতর্মানে ফেরিওলা লেইস-ফিতা বলতে বলতে বাড়ি এসেছিল। ঘর ফাঁকা দেখে ফেরিওলা আর সে সুযোগ নিয়েছে। বিনিময়ে ফেরিওলা সেদিনই তাকে একজোড়া কাঁচের চুড়ি আর একটা তাঁতের শাড়ি গিফট করে গেছে। তারপর তাদের আর দেখা হয়নি। বৃত্তান্ত শুনে গ্রাম কোহিনুর খালাকে বেকুব খেতাব দিল।

আমি প্রায় গলির মুখে পৌঁছে গেছি। দেখছি, ওষুধের দোকানে আর কে কে আছে। দেখলাম, একটা মহিলা। আঁতকে উঠলাম, এসব ব্যাপারে পুরুষের সামনে তাও মুখ খোলা যায়, মহিলার সামনে একেবারেই না। আমি যথেষ্ট শর্মিন্দা। না বাবা, একদম বলতে পারবো না। অগত্যা গলির মুখে গিয়ে মূল গলির কিছু দূর হেঁটে আবার পায়ে ব্রেক কষলাম। দেখি, মহিলাটা গেছে কিনা।

এতবড় একটা অঘটন। অথচ কোহিনুর খালা কিংবা আব্বার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। এর ক্রেডিট অবশ্য আম্মাকেই দিতে হয়। আম্মা যে কোনো মূল্যে তার সংসারটা স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তার সংসারে সুখ বহাল থাকবে, একমাত্র সন্তান মানুষের মতো মানুষ হবে। সবকিছু নিরাপদে এগোবে। সে হিসেবে আম্মার সংসার সত্যিই আজ স্বাধীন। তার সংসারের কোনো শত্রু নেই। শোষণ নেই, অত্যাচার নেই, নিপীড়ন নেই, নির্যাতন নেই। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যতধরনের অত্যাচার করেছিল তার কিছুই নেই আম্মার সংসারে নেই। সংসারটা স্বাধীন।
 আম্মা কোহিনুর খালাকে চরবাটা গ্রামের খালপাড়ে শনের একটা ঘর তুলে দিলেন। গ্রামের মানুষ তাকে খুব বাহবা দিল। বলল, ‘কত বড় দিল দরিয়া। মহিলার বাড়িতে থেকে মাগীটা পেট বাজাইছে অথচ তার রাগ নেই। বাড়ি করে দিছে।’ সে বাড়িতেই আমার আব্বার প্রেমিকা কোহিনুর খালা জীবন্ত কন্যা সন্তান প্রসব করলেন। গ্রামের সবাই জানে ফেরিওলার বাচ্চা পয়দা হয়েছে। শুধু কোহিনুর খালা, আব্বা আর আম্মা জানেন, আমার আব্বার বাচ্চা পয়দা হয়েছে। এরপর থেকে আব্বা সবকিছু থেকে সরে সরে থাকেন। কলেজে গিয়ে ক্লাশ নিয়ে চলে আসেন। বাড়ি শুয়ে ঘুমান। আম্মা অবশ্য প্রায়ই তাকে বলতেন, ‘চোরের মনে পুলিশ পুলিশ। তুমার কাণ্ডকীর্তি আমার ভালো লাগে না। আচার-আচরণ চেঞ্জ করি তুমিই তো পড়শীরে জানাইতেছ, কোহিনুর আমার পেয়ারী আছিল। কোন দরকার আছে এমন করার!’ আব্বা আম্মার কথা শুনে শক্ত হতে চেষ্টা করলেন। তারপর তিনি মুক্তি পেলেন। চাঁদপুরের একটা কলেজে তার এক বন্ধু শিক্ষক। আগেই তাকে বলেছিলেন সুযোগ থাকলে খবর দিতে। সুযোগ এলো, আব্বা নোয়াখালীর বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি টেনে চাঁদপুরে ভাড়া বসতি গাড়লেন। তখন থেকে আমরা চাঁদপুরে।
কোহিনুর খালা অবশ্য একটা রেয়ার তথ্য দিলেন তার হিস্টোরি ঘাঁটতে গিয়ে। জানালেন, আব্বা নাকি একরাতে চুপি চুপি সেই খালপাড়ে গিয়েছিল। কোহিনুর খালার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছে। আর বলেছে, তার মেয়ের সব ভরন-পোষণ সে পাঠিয়ে দেবে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন। তার কোনো চিন্তুা নেই। জবাবে কোহিনুর খালা বলেছিল, আন্নে কোনো চিন্তা করিয়েন না, আঁই আঁর আব্বার মতম লাকড়ির ব্যবসা করুম। খালি মাইয়্যা গা বুকের দুধ ছাইরবার আগে আন্নে খরচ হাডাইলে চইলবো।’
তারপর সেদিন চাঁদপুরের বাড়িতে কোহিনুর খালার আসার আগে আব্বার সাথে আর তার দেখা হয়নি। এবারো শুধু খাবার টেবিলে একসঙ্গে খেতে বসেছিলেন। খালা আব্বার দিকে প্রকাশ্যে তাকিয়েছিলেন কিনা দেখিনি। গোপনে তাদের দেখা হয়ে থাকলে শুধু খালা আর আব্বাই বলতে পারবেন। আম্মার এসব দেখার কোনো আগ্রহই নেই। 

আমি দেখলাম, ওষুধের দোকানে এখন কেউ নেই। দোকানী বসে পেপার পড়ছে। এই সুযোগ। গিয়েই দরকার হলে চোখ দোকানীর পেপারে রেখে চাইবো, যাতে লজ্জা না লাগে।

কোহিনুর খালা বেশিদিন থাকেন নি। বাড়িতে একলা মেয়ে রেখে এসেছেন। আম্মা বলেছিলেন, আবার যখন আইবা তখন মেয়েরে নিয়েই আসবা। একা আসলে বাড়ি ঢুকতে দিমু না।

আমার পড়াশোনার পর চাকরীটা হয়ে গেলে আমি আম্মাকে ঢাকায় নিয়ে এলাম। আব্বা এলেন না। তিনি চাঁদপুরেই বাড়ি করেছেন। অবশ্য থাকেন কলেজের হোস্টেলে। ছাত্রদের পড়ান। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাই এখন আমাদের নিজের বাড়িটা ফাঁকা। থাকার মানুষ নেই। বলতে গেলে, এখনো আমাদের সবাইকে ভাড়া বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। কোহিনুর খালা কদিন আগে আম্মাকে ফোন করেছিলেন। বললেন তার মেয়ের মেট্রিক পরীক্ষা শেষ। এখন আসতে চান। আম্মা জানালেন, তিনি তার ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। যদি তাকে দেখতে তার মন চায় তবে যেন ঢাকায় আসেন। আর যদি আব্বাকে দেখতে তার মন চায় তবে যেন চাঁদপুর যায়। আর যদি তাকে নিয়ে আব্বার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক হয় তাহলে যেন আগে ঢাকায় আসে পরে একসঙ্গে গিয়ে আব্বাকে দেখে আসবে দু’জনে মিলে। কোহিনুর খালা রাজি হয়ে গেলেন।
কোহিনুর খালা আর আম্মা আজ সকালে ঢাকার বাসা থেকে রওয়ানা হয়েছেন চাঁদপুরের উদ্দেশে। সেখানে তারা আমাদের চাঁদপুরের বাড়িতে আব্বার সাথে দুদিন সময় কাটাবেন। কোহিনুর খালাও রাজি হয়েছে। দিনে দিনে তার চক্ষুলজ্জাটা কমেছে। এখন মেয়ে বড় হয়েছে। লজ্জা করে আর কি লাভ! মেয়ের বাপের পরিচয়টা টেকসই করতে না পারলে বিয়েতে সমস্যা হবে। আরো একটা কথা বলতে বলতে ভুলে গেছি। এখন আর আব্বাকে আমাদের জন্য কোনো খরচা দিতে হয় না। আম্মা তাকে আদেশ করেছেন, তার বেতনের অর্ধেক টাকা কোহিনুর খালার নামে কুরিয়ার করে দিতে। তাই কোহিনুর খালা আর তার মেয়ের এখন কোনো অভাব নেই। অবশ্য আগেও ফি মাস কিছু না কিছু টাকা আব্বা পাঠিয়ে দিতেন। খালা আর আম্মা চলে যাবার পর বাসায় আছি আমি আর কোহিনুর খালার মেয়ে।
সে খালি হিন্দি সিরিয়াল দেখে। বাসায় যতক্ষন টিভির সামনে বসে থাকবে, সিরিয়ালে মশগুল। একা একা হাসে, কাঁদে। আমিতো ভয়ই পেয়েছিলাম। জানতে চাইলাম, কাঁদো কেন? সে বললো, ‘আহা রে রাধিকার পিতৃপরিচয় নাই। মা তাকে একা নিয়ে নগরে নগরে ফেরে। কোথাও আশ্রয় নেই।’ আমি বললাম, ‘আহারে’!

পরেই আমার মনে হলো, কেমন মেয়েরে বাবা! নিজের জীবনটাও তো তার সিরিয়ালের মতো, তাই নিয়ে দেখছি কোনো টেনশন নেই, কাঁদছে রাধিকার জন্যে!
কোহিনুর খালার হিস্টোরি তো শেষ। আর নেই। অবশ্য আমার একটা হিস্টোরি জমতে যাচ্ছে। একেবারেই অন্যরকম হিস্টোরি। বলতে ভয় নেই, এব্যাপারে আমি একেবারেই আমার মায়ের মতো হয়েছি। আমি তো কোহিনুর খালার মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি। এ কদিনে আমি ও সে যদি প্রেম থাকে তবে প্রেমের অনেক গভীরে চলে গেছি। অবশ্য কোহিনুর খালার মেয়েটা জীবনকে সিরিয়ালের বাস্তবতা থেকে দেখে। সে জীবনের বাস্তবতায় নেই। তার মধ্যে প্রেম বলতে কিছু নেই। কথা বলে যদ্দুর বুঝতে পেরেছি, তার ভাবগতিক এমন, প্রেম-টেমের মূল্য তার কাছে নেই। সিরিয়ালের পরকিয়ার সম্পর্ক সে বেশ উপভোগ করে।
আজ খালা ও আম্মা যাবার পর আমি প্রথম তার ঠোঁটে চুমু খেলাম। আমার আম্মার মতো মেয়েটার মধ্যেও কোনো জড়তা নেই। হিসেব করলে আমি তার ভাই হই। কিন্তু এসব ব্যাপারে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তার অন্তরে ব্যথা। ভাবখানা এমন, ‘বাপ’র সম্পর্কেরই ঠিক নাই, ভাই খুঁজে বের করে কি হবে?
কোহিনুর খালার মেয়ে অনেক এলার্ট। আজ আমরা হয়তো শারীরিক সম্পর্ক গড়তে যাচ্ছি প্রথমবারের মতো। দু’জনে আলাপও সেরে নিয়েছি। তার কাছে এসব কোনো ব্যাপারই না। আমি গদগদ হয়ে জানতে চাইলাম, ‘সহজ ভাবে নিতে পারবে তো?’ সে বলল, ‘আরে! সহজ-কঠিনের কি আছে এখানে! কাজের কথায় আসো। যাও কনডম নিয়ে আসো গিয়ে।’ আমি তাই এতক্ষণ জীবনের প্রথমবারের মতো কনডম কিনতে আমাদের বাসার সামনের গলিটায় হাঁটছিলাম। যাবো গলির মুখে। ঘেমে গেছি ভয়ে। ভাবছি কথাটা দোকানদারকে কিভাবে বলি। এই ভয়-ভীতির মধ্যেই কখন যে মাথায় কোহিনুর খালার হিস্টোরিটাও ঢুকে গেছে টের পেলাম না। দু’টার সঙ্গে কি কোনো সম্বন্ধ আছে? তাহলে?
আর এখন ভাবছি কোহিনুর খালার মেয়ের সাহসের কথা। তারিফ করার মতো সাহস। অবশ্য এখন তো আমাদেরই সাহস দেখাবার বয়স, তাই না? আব্বাটা কেমন ভেতরমুখি হয়ে গেছে। বেচারা একাকী জীবন যাপন করছে। স্ত্রী-সন্তান পাশে নেই। আম্মারও সাহস দেখানোর সময় ফুরিয়ে আসছে। তার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। রোজ ইনসুলিনের সিরিঞ্জ ঢুকছে শরীরে। আর গতকাল জানতে পেরেছি, কোহিনুর খালার জরায়ূতে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তারা এই পৃথিবীতে আর কি সাহস দেখাবে? তাই সবাই চাঁদপুর গেছে একসঙ্গে ভীতির জন্ম দিতে। আব্বার কাছে গেছে দু’জনে নিঃসঙ্গ ধার নিতে। আম্মাটাও হয়তো ফিরে এসে কেমন জানি হয়ে যাবে। তারতো আর কিছুই চাওয়ার নেই, তার সংসার স্বাধীন হয়ে গেছে, স্বাধীনতা বজায় আছে। আমাদের চাওয়ার আছে অনেক কিছুই। তাই আমি আর কোহিনুর খালার মেয়ে আজ দু’টা সংসারকে জোড়া লাগাবো। মানসিককে সবসময় পোষায় না, শারীরিকও লাগে। তাই আমরা মিলিত হবো মূলত আমাদের আম্মা আর আব্বাকেই এক করতে। জীবনের শেষ পর্যায়ে অন্তত তাদের মিলন ঘটানো দরকার।

আমি এবার সাহস সঞ্চয় করে দোকানে উপস্থিত হলাম। দোকানীকে বললাম,‘এক প্যাকেট সেনসেশন দেন তো!’
দোকানী হয়তো অবাক হলো, এত লজ্জার কি আছে! কিন্তু আমি লজ্জা পাচ্ছি। নানা কিছু ভেবে লজ্জা পাচ্ছি। যিনি জীবনে প্রথম কনডম কিনতে গেছেন,তিনি জানেন কি সেই লজ্জা।
দোকানদার বলল,‘ভাই, সেনসেশন তো মার্কেটে নাই, গ্রীন লাভ আছে, দিমু?’
আমি জড়তা নিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। দোকানদার আমাকে দিল এক প্যাকেট গ্রীন লাভ। তিনটা থাকে এক প্যাকেটে।
আর ওদিকেও তিনজন-কোহিনুর খালা, আম্মা আর আব্বা। আমি বিড়বিড় করছি, ভালো হবে তো? গ্রীন...লাভ...লাভ...গ্রীন...গ্রীন লাভ!