(প্রিয়.কম) - ধব ধবে সাদা। এমন সাদা রূপের বাহার শুধু বক পাখির। দুধ-সাদা, কাশফুল, শরতের মেঘের মত কিংবা শিমুল তুলা রঙা সাদা বক। অহরহ ওই রঙের বক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুই চারটি বিভিন্ন স্থানে দেখা মিলে। কিন্তু ওই রঙের হাজারো বক একত্রিত হয়ে একটি বাড়িকে আপন করে নেয়ার ঘটনা খুব একটা বেশী নয়। বাড়িটি এক সময় হেমন্ত পাটনি বাড়ি নামে পরিচয় থাকলেও তা বকের জন্য বাড়ির নাম পাল্টে গেছে। দীর্ঘ বছর ওই বাড়িতে এসে বসবাসের কারণে ‘বকের বাড়ি’ এ পরিচয় এখন সবার কাছে।
সকাল-দুপুর-বিকেল বকের কোলাহলে বাড়ির সবুজ গাছগুলোতে সাদা রঙে ছড়িয়ে থাকে। সারাক্ষন আহার সংগ্রহে ছুটে যাওয়া কিংবা ফিরে আসায় ওরা মেতে ওঠে। এছাড়াও সকালে এবং বিকেলে ঝাক বেধে আহারে উদ্দেশ্যে নেমে পড়া কিংবা বিকেলে আবার নীড়ে ফিরে আসার এমন দৃশ্য ওই বাড়িকে ঘিরেই দেখা যায়। তাই বিভিন্ন বয়সের দর্শনার্থীরা সকাল ভিড় জমায় বাড়িটি ঘিরে। এ সময় পুরো এলাকা জুড়ে আন্দোলিত হয় বকের কলতানে। হাজারো এই বকের মেলা পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নুরাইনপুর বাজারের পাটনি বাড়ি। সংখ্যায় বেড়ে যাওয়ায় বকগুলো এখন ছড়িয়ে পড়েছে পাশের মজিদ মৌলুবি ও হাবিব কাজীর বাড়ির গাছগুলোতে। দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছরের অধিক সময় ধরে ওই বাড়িতেই থাকে বকগুলো। ওই উপজেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তরে নুরাইনপুর বাজারের বকের বাড়ির অবস্থান।

বিজয় পাটনি
প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বকগুলোকে কেউ আঘাত করে না, কেউ তাড়ায় না এ কারণে সময় হলে এরা আসে আবার চারদিকের পানি শুকিয়ে গেলে চলে যায়। অনেক সময় বক ছানা মাটিতে পড়ে গেলে গাছে উঠিয়ে দেয়া হয়। ওদের প্রতি এলাকার সবারই মায়া আছে।’
এক সময় লঞ্চঘাটকে ঘিরে গড়ে ওঠে নুরাইনপুর বাজার। তাই ওই ঘাটকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াতে হাজার যাত্রীর আনাগোনা প্রতিদিন নুরাইনপুর ঘাটে। দিনের আলোয় বকের নানা কতসরত লঞ্চযাত্রী কিংবা বাজারে আগন্তুকদের প্রকৃতির সাথে আপন করে তোলে। এই বকগুলোর টানে অনেকেই ছুটে আসেন নারাইনপুর লঞ্চঘাটে কিংবা বাজারে।
পার্শ্ববর্তী দশমিনা উপজেলা সদরের ব্যবসায়ী মো. রায়হান সিকদার
প্রিয়.কমকে জানান, নিজের উপজেলায় ঢাকা যাওয়ার লঞ্চঘাট থাকলেও বর্ষা মৌসুমে তিনি প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নুরাইনপুর লঞ্চঘাট দিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করেন। এজন্য প্রায় এক থেকে দেড় ঘন্টা আসে আসেন ঘাটে বক দেখতে।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার বক আমি আর কোথাও দেখিনি। বকগুলো দেখতে খুব ভাল লাগে।’
এমন অনেকেই হয়তো রায়হান সিকদারের মত এই বকগুলোর কারণে এই পথে ঢাকায় যাতায়াত করেন। বছরের চৈত্র মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত বকগুলো ওই বাড়ির গাছে বসবাস করে। তারপর নদী-খাল-বিলের পানি শুকিয়ে গেলে বকগুলো চলে যায়। আবার একই সময়ে ওই বাড়িতে এসে কলনী তৈরী করে।

শুধু এক প্রজাতির বকই না। ছয় প্রজাতির বক বাসা বুনে ওখানে। এর হলো ধূসর বক, বড় সাদা বক, মাঝারি সাদা বক, ছোট সাদা বক, ছোট বক ও ময়ুরপক্সক্ষী বক। এরমধ্যে সংখ্যায় বেশী বড় বক ও ময়ুরপক্সক্ষী বক। এসব প্রজাতির বকগুলো প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন মগডাল দখল করে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডাল পালা দিয়ে অগোছালো ভাবে বাসা বুনে ওরা। এসব বক তিন থেকে সাতটি ডিম দেয়। ২৮ থেকে ৩২ দিনে বাচ্চা ফোটে। দুই মাস বয়স পেরুলেই আকাশে উড়তে শুরু করে বকের ছানা। ওই কলনীতে বসবাস করে বছরের প্রায় ৯ মাস। চৈত্র মাসে নদী-নালা কিংবা খাল-বিলে পানি আসার সাথে সাথে ওরা চলে আসে ওই বাড়িতে। এরপর প্রায় আগ্রহায়ন মাস পর্যন্ত থাকে ওখানে। এরমধ্যে বর্ষার প্রজনন মৌসুমে হাজারো বক ছানা জন্ম নেয় ওখানে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ফুহাদ বিশ্বাস
প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই আমরা দেখে আসছি বকগুলো ফাল্গুন চৈত্র মাসে আসে আবার অগ্রহায়ন মাসের শেষের দিকে চলে যায়। অনেকে সকাল বিকেল এখানে আসে বক দেখতে।’
দীর্ঘ বছর একই স্থানে প্রজননসহ কলনী গড়ে তোলা সম্পর্কে পাখি বিশেষজ্ঞ ও পটুয়াখালী সরকারি কলেজের অবসর প্রাপ্ত প্রাণী বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পিযুষ কান্তি হরি
প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এরা সাধারণত জলাশয়ের কাছাকাছি পছন্দের এলাকায় বড় গাছের ডালে কলনী গড়ে তোলে। মানুষের আক্রমন না হলে কমপক্ষে একটানা ২৫ থেকে ৩০ বছর একইস্থানে কলনী কিংবা বসতি গড়ে তোলে।’
মহিব্বুল্লাহ্ চৌধুরী, পটুয়াখালী থেকে